কয়রা খুলনা প্রতিনিধিঃ
খুলনার কয়রা উপজেলার প্রশাসনিক ভিত্তি ও সামাজিক অগ্রগতির যে শক্ত ভিত, তার এক নীরব স্থপতির নাম সৈয়দ আলী সানা। আজ ২ জুন তাঁর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। সময়ের ব্যবধানে নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তাঁর নাম শোনেনি, তবে যাঁরা স্মরণে রেখেছেন, তাঁদের কণ্ঠে এখনো উচ্চারিত হয় কৃতজ্ঞতার ধ্বনি—“এই মানুষটি না থাকলে কয়রার বর্তমান চিত্র অনেকটাই ভিন্ন হতো।”
কয়রা সদরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জন্ম নেওয়া সৈয়দ আলী সানা ছিলেন ঐতিহ্যবাহী সানা পরিবারের সন্তান। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধে গড়ে ওঠা এই পরিবার কয়রার নানা ইতিবাচক আন্দোলনের পথিকৃৎ। সেই ধারাবাহিকতায় সৈয়দ আলী সানা নিজেকে উৎসর্গ করেন সাধারণ মানুষের জন্য।
৮০ ও ৯০-এর দশকে কয়রা ছিল এক ধরনের প্রত্যন্ত জনপদ। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাতে গোনা, রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত, স্বাস্থ্যসেবা প্রাথমিক পর্যায়ে। সেই প্রেক্ষাপটে সৈয়দ আলী সানা একাই দাঁড়িয়েছিলেন উন্নয়নের ডাক নিয়ে। কয়রাকে উপজেলা হিসেবে গড়ে তোলার আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে—প্রশাসনের সঙ্গে সংলাপ, স্থানীয় মানুষকে সংগঠিতকরণ, দাবি-দাওয়া উপস্থাপন—সবই তিনি করেছেন প্রচারের বাইরে থেকে।
তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত। কখনো দরিদ্র শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়েছেন বই, কখনো নদীভাঙা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন খাদ্যসাহায্য নিয়ে। স্কুলে মেয়েদের নিরাপদ যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছেন, আবার কোনো অসুস্থ বৃদ্ধের চিকিৎসা ব্যয়ের যোগানও দিয়েছেন।
অনেকেই বলেন, তাঁর বাড়িটি ছিল যেন ‘জনসেবার খোলা দরজা’। সকাল হতেই সেখানে ভিড় করতেন প্রান্তিক মানুষজন—কারও সরকারি কোনো ফর্ম পূরণে সাহায্য লাগতো, কারও চাকরির সুপারিশ, কেউবা আসতেন স্রেফ একটা পরামর্শ নিতে। তিনি কোনো জনপ্রতিনিধি ছিলেন না, ছিলেন মানুষের নেতা।
তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল দলমত নির্বিশেষে। বিভিন্ন সময় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। কয়রার প্রবীণ ইউপি চেয়ারম্যান শাহবুদ্দিন আহমেদ বলেন, “তিনি ছিলেন জনগণের নেতা, কোনো দলের নয়।”
পেশাগত জীবনে সৈয়দ আলী সানা ছিলেন একজন পোস্টমাস্টার। কিন্তু তার বাইরেও তাঁর ভূমিকা ছড়িয়ে পড়েছিল মসজিদ, মাদ্রাসা ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়। বহু প্রতিষ্ঠান আজও টিকে আছে তাঁর দান ও পরিকল্পনায়।
২০০৭ সালের ২ জুন তিনি ইন্তেকাল করেন। আজ তাঁর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কয়রা সদরের বিভিন্ন মসজিদে মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। সকাল থেকেই স্বজন, শুভানুধ্যায়ী ও সাধারণ মানুষ ভিড় করেছেন তাঁর বাড়িতে। কোরআনখানি, দোয়া এবং স্মৃতিচারণায় তাঁকে স্মরণ করছেন সবাই।
একজন সৈয়দ আলী সানা হয়তো আর নেই, কিন্তু কয়রার অগ্রযাত্রায় তাঁর রেখে যাওয়া ছাপ রয়ে গেছে স্থায়ী ও শ্রদ্ধেয় হয়ে।