প্রভাষক জাহিদ হাসান
রিজিক শব্দটি আরবি ভাষা থেকে এসেছে, যার আভিধানিক অর্থ হল জীবিকা বা জীবনধারণের উপায়। পরিভাষায় আমাদের সামগ্রিক জীবনযাপনের সাথে জড়িত আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত উপকরণ সমূহকে রিজিক বলা হয়। রিজিক মূলত ২ প্রকার: ১) ধন সম্পদের রিজিক, ২) অন্তর- আত্মার রিজিক। ব্যক্তির মৌলিক সম্পদগুলো ব্যতীত আরও যে সকল প্রকারের রিজিক রয়েছে তা হলো, ১) ঈমান, ২) সুস্থতা, ৩) ইলমে দ্বীন, ৪) নেককার জীবনসঙ্গী, ৫) নেককার সন্তান ইত্যাদি। রিজিকের বিভিন্ন স্তর হলো- নিম্নতম স্তর: অর্থ- সম্পদ। সর্বোচ্চ স্তর: শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। সর্বোত্তম স্তর: পুণ্যবান জীবনসঙ্গী ও নেক সন্তান। পরিপূর্ণ স্তর: আল্লাহর সন্তুষ্টি।
মানবজীবনে রিজিকের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে হালাল উপায়ে রিজিক অন্বেষণের নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের পুরো জীবনের সকল কর্মকান্ড যা দ্বারা নির্ধারিত তাই হলো রিজিক। আমরা কি খাবো, কি পরবো, কি আয় করব, কোথায় যাব তথা জীবনের প্রতিটি কর্মকাণ্ড আল্লাহতায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত। সমস্ত মাখলুকাতের জীবন-উপকরণের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা নিজেই গ্রহণ করেছেন। আল্লাহর জমিনে প্রতিটি প্রাণীই আল্লাহর দেওয়া রিজিক ভোগ করে থাকে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও হাদীস শরীফে রিজিক সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। রিজিক সম্পর্কে পবিত্র কোরআন- হাদীসের কিছু বক্তব্য নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে –
১। “অতঃপর যখন জুমার নামাজ শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর।” (সূরা জুমুয়াহ, আয়াত ১০)
২। “পৃথিবীর প্রত্যেক জীবের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছুই (উল্লেখ) এক সুবিন্যস্ত কিতাবে (লাওহে মাহফুজে) রয়েছে।” (সূরা হুদ, আয়াত ৬)
৩। “এবং তিনি তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দান করেন যার উৎস সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।” (সূরা ত্বালাক, আয়াত ৩)
৪। “নিশ্চয় আল্লাহ হলেন তিনি, যিনি রিজিকদাতা এবং মহাশক্তিধর ও মহাপরাক্রমশালী।” (সুরা যারিয়াত, আয়াত ৫৮)
৫। “‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব, কখনো ভয়ভীতি, কখনো অনাহার দিয়ে, কখনো তোমাদের জানমাল ও ফসলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। (এমন পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করতে হবে) তুমি ধৈর্যশীলদের (জান্নাতের) সুসংবাদ দান করো।” (সূরা বাকারা, আয়াত ১৫৫)
৬। “নিশ্চয় তোমার রব যাকে ইচ্ছা তার জন্য রিজিক বাড়িয়ে দেন এবং যাকে ইচ্ছা তার জন্য রিজিক সীমিত করে দেন। আর অবশ্যই তিনি তার বান্দাদের সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত এবং প্রত্যক্ষদর্শী।” (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ৩০)
৭। “পার্থিব জীবনের ওপর কাফেরদের উন্মত্ত করে দেওয়া হয়েছে। আর তারা ইমানদারদের প্রতি লক্ষ করে হাসাহাসি করে। পক্ষান্তরে যারা পরহেজগার তারা সেই কাফেরদের তুলনায় কেয়ামতের দিন অত্যন্ত উচ্চমর্যাদায় থাকবে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সীমাহীন রুজি দান করেন।” (সূরা বাকারা, আয়াত ২১২)
৮। “আকাশে রয়েছে তোমাদের রিজিক ও প্রতিশ্রুত সব কিছু।” (সূরা জারিয়াত, আয়াত ২২)
৯। “এমন কে আছে, যে তোমাদের রিজিক দান করবে? যদি তিনি তাঁর রিজিক বন্ধ করে দেন?” (সুরা মূলক, আয়াত ২১)
১০। “যদি আল্লাহ তায়ালা তাঁর সব বান্দাদের প্রচুর রিজিক দান করতেন, তাহলে তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করত। বরং তিনি যে পরিমাণ চান তার জন্য ততটুকুই রিজিক নাজিল করেন।” (সূরা শুয়ারা, আয়াত ২৭)
১১। “আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি দয়ালু, যাকে ইচ্ছা রিজিক দান করেন, তিনি প্রবল পরাক্রমশালী।” ( সুরা শুরা, আয়াত ১৯)
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে –
১। হযরত রাসূলে কারীম (সা) বলেছেন, “হে মানুষ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। ধনসম্পদ সংগ্রহে উত্তম পন্থা অবলম্বন করো। কেননা কেউ তার রিজিক পরিপূর্ণ না করে মৃত্যুবরণ করবে না। যদিও তা অর্জনে বিলম্ব হোক না কেন।” (সুনানে ইবনে মাজাহ)
২। হযরত ওমর (রা) থেকে বর্ণিত, রিজিক সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, “তোমরা যদি আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের রিজিকের ব্যবস্থা করতেন। যেমনভাবে তিনি পাখিদের রিজিকের ব্যবস্থা করে থাকেন। তারা তো সকালে খালি পেটে ক্ষুধা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়, আবার শেষ বিকেলে ভরা পেটে বাসস্থানে ফিরে আসে।” (তিরমিজি শরীফ)
৩। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) মাতৃগর্ভে মানবশিশু জন্মের স্তর সম্পর্কে এভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্যের আকারে ৪০ দিন, জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়ে ৪০ দিন, গোশত আকারে ৪০ দিন। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন যে, তার (শিশুর) আমল, রিজিক, আয়ুষ্কাল ও ভালো না মন্দ—সব লিপিবদ্ধ করো। অতঃপর তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেওয়া হয়।’ (সহীহ বুখারী)
এজন্যই হযরত হাসান বসরী (রহ) বলেছেন, আমি কোরআনের নব্বই জায়গায় পেয়েছি, আল্লাহ তায়ালা বান্দার রিজিক নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং রিজিকের দায়িত্ব নিয়েছেন। কেবল এক জায়গায় পেয়েছি, ‘শয়তান তোমাদেরকে অভাব-অনটনের ভয় দেখায়।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৬৮)
পবিত্র কোরআন ও হাদীসের বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রিজিক একমাত্র আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক নির্ধারিত। সুতরাং রিজিকের জন্য মানুষকে চেষ্টা করার পাশাপাশি অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালাই জীবন-উপকরণ দান করেন। মানুষ নিতেও পারে না, দিতেও পারে না, মাধ্যম হতে পারে মাত্র। সবাই আল্লাহ প্রদত্ত নির্ধারিত রিজিক অবশ্যই পাবে। কাজেই কে, কখন, কী খাবে, কোথায় যাবে, কতদিন কোন স্থানে অবস্থান করবে, কোন দেশে কিভাবে থাকবে, সংসার কেমন হবে, মৃত্যু কখন- কোথায়- কিভাবে হবে, কবর কোথায় হবে- সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। এসব বিষয়ে অবিশ্বাসীরা প্রকৃত ঈমানদার নয়। আর যারা আল্লাহকে রিজিকদাতা বিশ্বাস না করে, মাখলুককে রিজিকদাতা মনে করে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও অপমানিত হবে বলে পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সত্যিকারের মুমিনদের হতাশ হওয়ার কিছুই নয়, তাকদিরে আমাদের জন্য যতটুকু বরাদ্দ আছে, ততটুকুই আমরা পাবো- এটাই আল্লাহর ওয়াদা। আমাদের কাজ শুধু চেষ্টা করে যাওয়া। যে বিষয়ে আল্লাহ হুকুম করেছেন- তা মানা, আর যে বিষয়ে আল্লাহ নিষেধ করেছেন, তা থেকে নিচেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য। মহান আল্লাহ কর্তৃক লিপিবদ্ধ রিজিক থেকে আমরা বিন্দুমাত্র বঞ্চিত হবো না, আবার এর চেয়ে বেশি কিছুও পাবো না। ঈমানদারদের জন্য রিজিকে বিশ্বাস করা অপরিহার্য। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে রিজিক সম্পর্কিত পবিত্র কোরআন ও হাদীসের নির্দেশনাসমূহ মেনে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
লেখক: প্রভাষক জাহিদ হাসান
জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ।
মোবাইল: ০১৭১২-৮৮৩৮৯৫
ইমেইল: lecturerjahidhasan@yahoo.com