লেখক: সেখ আলমগীর রহমান
তেঁতুলডাঙা গ্রামে যারা থাকে তারা জানে সকালটা কেমন হয় এক পেট খিদে আর মাটির ফেটে যাওয়া ছেঁড়া স্তব্ধতায়। দুলাল ওই গ্রামের একজন কৃষক, তবে নামেই। জমি বলতে এক বিঘা, তাও চরে বালুর ভেতর। বউ শিউলি হেঁশেলে চুলা ধরায় শুকনো খড় জোগাড় করে, আর ছেলে মন্টু সবে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, স্কুলে যাবার নাম করে চাষের মাঠে ছুটে যায়, কারণ পেটটা আগে। দুলালের একটা গরু আছে, তার নাম শ্যামলী। এই গরুটা তার কাছে কেবল একটি জীব নয়, বরং তার সমস্ত সংসারের মেরুদণ্ড। ফসল হয় না ঠিকই, কিন্তু শ্যামলীর দুধ বিক্রি করে প্রতি সপ্তাহে একবার চাল কেনা যায়, ছেলের জন্য একদিনের ডাল, আর রোগা বউয়ের জন্য আধপাটি শাক।
শ্যামলী সাত বছর ধরে ওদের ঘরে আছে। দুলালের বাবা তাকে এনেছিলেন হাট থেকে, তখন সে ছোট ছিল। দুলাল নিজে হাতে তাকে খড় খাইয়েছে, জ্বরে জ্বললে কাঁথা জড়িয়ে রেখেছে রাতে, কখনও কখনও নিজের পাতে কম খেয়ে তাকে খাইয়েছে। বউও যেমন করে নিজের বাচ্চার যত্ন নেয়, শিউলিও শ্যামলীর গা ঘষে, কোদাল দিয়ে তার গোয়াল ঘরের জায়গা পরিষ্কার করে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, তুই আমাদের মা।
একদিন সকালবেলা দুলাল উঠেই দেখে গুদামে আর এক মুঠো চালও নেই। মন্টু বলল, বাবা, আজ স্কুলে ভাত চাই, না দিলে আমি যাব না। শিউলি তাকিয়ে থাকে, চোখে কোন ভাষা নেই। দুলাল পায়ের নিচে ফাটা মাটি দেখে, ভাবে কী করবে। গ্রামের মুদি কালু তাকে আর বাকিতে দেবে না, বলে গেছে কদিন আগেই। পাটের দাম পড়ে গেছে, নতুন বীজ কেনা হয়নি। খেতের ফসল উঠবে না নিশ্চিত। শুধু শ্যামলী দুধ দেয়, দিনে আধ সের। তাও পাড়া-পড়শিরা এখন আর দুধ নেয় না, বলে জল মেশাও।
বিকেলে দুলাল বসে থাকে বারান্দায়। গরুর দড়ি হাতের আঙুলে প্যাঁচানো। শ্যামলী মাটির ওপর শুয়ে কুঁকড়ে পড়ে আছে, বুঝছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তার গলা ঘষে ঘষে বেরোয় হালকা গোঙানির শব্দ। হঠাৎ পাশের বাড়ির কালু এসে বলে, দুলাল ভাই, যদি গরুটা দিতে পারিস, আমার ভাইপো এক হাজার দেবে। দুলাল কিছু বলে না, শুধু মাথা নিচু করে। কালু চলে যায়, রেখে যায় প্রশ্ন। রাতের বেলা ঘরে আলো নেই, কেরোসিন তেলও শেষ আগুন মরে গেছে। শিউলি বলে, বিক্রি করো গরুটা, না হলে মন্টু না খেয়ে থাকবে। আমি পারছি না আর। তার গলা ধরে আসে, চোখে জল থেমে থাকে না। দুলাল কিছু বলে না, কেবল শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে থাকে। শ্যামলীও তাকিয়ে থাকে, চোখে ভরসা, যেন বিশ্বাস করে যে দুলাল তাকে দেবে না।
পরদিন সকালে দুলাল গরুর গলায় দড়ি বেঁধে রওনা দেয় হাটের দিকে। পেছনে পেছনে মন্টু ছুটে আসে, বলে, বাবা গরুটা বিক্রি কোরো না, আমি খাব না, স্কুল যাব না, শুধু দাও না গরুকে। দুলাল তার মুখে হাত রাখে, বলে, বাঁচার জন্য কিছু তো করতে হয়। হাটের রাস্তা মেঠো, পাশে ধুলার আস্তরণ। গরুটা হাঁটে, কিন্তু পা ফেলে ধীরে, চোখে জল, কখনও ঘাড় ঘুরিয়ে দুলালের চোখে চোখ রাখে।
হাটে পা দিয়েই দুলালের বুক ধকধক করে। চারদিকে গরু, ছাগল, মুরগি, আর তাদের পাশে দাঁড়ানো বিক্রেতা। ক্রেতারা পছন্দের পশুর দেহে হাত বুলিয়ে দেখে, দাঁত টেনে দেখে বয়স, কেউ কেউ দাম কষে কষে তুই তোকারি করে। দুলাল শ্যামলীর গলায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ কাছে এলে সে যেন লজ্জায় পড়ে যায়, মাথা নিচু করে বলে, হ্যাঁ বিক্রি করব।
এক লোক আসে, বড় গোঁফ, হাতে সোনালি ঘড়ি। সে শ্যামলীর গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, দুধ দেয় কেমন? দুলাল বলে, আধ সেরের কিছু কম। লোকটি বলে, বেশি দিচ্ছিস, দেখি গাভিন তো? দুলাল চুপ করে। লোকটি দাম কষে দেয় আটশো। দুলাল কিছু বলে না, ভাবে, বাড়ি ফিরলে চাল কিনবে, ছেলের বইয়ের খাতা কিনবে। সে টাকা নেয়, দড়ি এগিয়ে দেয় লোকটির হাতে।
শ্যামলীর চোখে জল। সে চিৎকার করে ওঠে একবার, যেন সমস্ত হাট জানে যে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। দুলালের বুক চিরে যায়, কিন্তু কিছু বলে না। লোকটি গরুকে হাঁটায়, শ্যামলী একবার দুলালের দিকে তাকায়, তারপর থেমে যায়। পেছনে মুখ ঘুরিয়ে আর একবার দেখে, যেন বলছে, আমায় কেন ছেড়ে দিলে।
দুলাল বাড়ি ফেরে। হাতে টাকা। মন্টু দৌড়ে আসে, বলে, বাবা গরু কই। দুলাল কিছু বলে না, শুধু চোখে জল। শিউলি এসে বলে, ভাত রেঁধে দিই? দুলাল বলে, হ্যাঁ, দাও। কিন্তু খেতে বসে সে এক গ্রাস মুখে তুলতে পারে না। মনে হয়, শ্যামলী এখন কোথায়, কে তাকে কী দিচ্ছে, সে কি খাচ্ছে কিছু, না কাঁদছে।
রাত নামে। শিউলি ঘুমোয় ছেলের পাশে। দুলাল বারান্দায় বসে থাকে, কেবল কানে বাজে একটানা গোঙানির শব্দ, জানে না আসল না কল্পনা।
পরদিন সকালে ঘর থেকে বের হতেই পায় একটুকরো খবর, পাশের হাটের দিকে যে গরুটি কাল বিক্রি হয়েছিল, সে রাতে কিছু খায়নি, শুয়ে পড়েছিল খুপরি গর্তে, সকালে উঠে দেখে আর শ্বাস নেই। লোকটা বলে, অভিমানে গরুটি মরে গেছে।
দুলাল পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে। তার পায়ের তলায় জমি সরে যায় না, মুখে কোনো শব্দ ওঠে না। শুধু চোখ থেকে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়ে শুকনো মাটির ওপর, আর সেইখানে একটা ছোট্ট অদৃশ্য ঘাস গজায়।