লেখক: মো: রুহুল আমিন রকি
একটা সময় ছিল, যখন চারজন মিলে প্রতিদিন স্কুল শেষে মাঠে ফুটবল খেলত। তখন তারা জানতো না ভবিষ্যতে কে কী হবে, কোথায় যাবে। তারা শুধু জানতো—একসাথে থাকা মানেই আনন্দ, আর ভালোবাসা।
সময়ের স্রোতে সবকিছু বদলে গেছে।
চারজন বন্ধু আজ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে।
তবুও একটা জিনিস আজও ঠিক আগের মতোই আছে—
রাত ১০টার আড্ডা।
আব্দুর রহমান মানিক ব্যাবসা,,,সাইদুজ্জাম সোহেল ব্যাবসা,,আকশ দেবনাথ চাকরি,,মুনিরুজ্জামান মুনির চাকরি।
স্কুল মাঠে একসাথে খেলাধুলা করা চারজন বন্ধু—আজ জীবনের বিভিন্ন রাস্তায় চলেছে।
কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী।
তবুও একটা সময় আছে, একটা জায়গা আছে,
যেখানে তারা সবাই ঠিক আগের মতো—একদম খাঁটি, প্রাণবন্ত, আর নিখুঁত বন্ধুত্বের বাঁধনে বাঁধা।
মানিক এখন একটি ইলেকট্রনিক্স দোকানের মালিক। সকালে দোকান খোলে, রাত ৯টার মধ্যে গুছিয়ে ফেলে সবকিছু। দিনের শেষে ক্লান্ত মুখেও তার একটা বিশেষ জিনিস থাকে—“রাত ১০টার সময় ঠিক রাখতে হবে!”
সেই সময়টাই তার প্রিয়, যখন দোকানদার মানিক হয়ে যায় সেই পুরনো মানিক—বন্ধুদের জন্য নিবেদিত প্রাণ।
সোহেল শহরের একটা মোবাইল শপ চালায়।
দিনভর নতুন মডেল, স্ক্রিন গার্ড, চার্জার, কাস্টমারদের কথার ঝাঁপিতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
তবুও ঠিক ৯:৪৫ এ দোকানের ঝাঁপ ফেলে দেয়।
সোহেল বলে, “মোবাইল যতই স্মার্ট হোক, বন্ধুত্বের মতো কনেকশন আর কোথায়!”
মুনির একজন মার্কেটিং অফিসার, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৮টা পর্যন্ত কাজ করে। বাড়ি ফিরে কিছুটা বিশ্রাম নেয়, তারপর ফ্রেশ হয়ে বের হয়।
রাত ১০টার ঠিক ৫ মিনিট আগে সে পৌঁছায়। তার ব্যাগে থাকে কিছু খবর—কে প্রোমোশন পেল, অফিসে কী হলো।
তবে সবচেয়ে বড় খবর থাকে মুখে হাসি নিয়ে বলা—“তোদের সাথে দেখা না হলে এই জীবনটাই ফাঁকা মনে হয় রে।”
আকাশ দেবনাথ একজন সেলসম্যান। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে দোকানে দোকানে পণ্যের হিসাব নিকাশ করার জন্য। কিন্তু রাত ১০টার পর সেই চাকরিজীবীর মুখে ফুটে ওঠে একেবারে ভিন্ন এক উজ্জ্বলতা।
বন্ধুদের সঙ্গে বসে হালকা তামাশা, পুরোনো দিনের গল্প, আড্ডার মাঝে মাঝে হাসির দমক—এগুলোই যেন জীবনের আসল সুখ।
তাদের নির্ধারিত জায়গা: শহরের এক কোনায় ছোট্ট একটা চায়ের দোকান।
দোকানের নাম কেউ রাখেনি, দরকারও হয়নি।
চা বানায় ‘কানাই চাচা’, যিনি নিজেও জানেন না তিনি কতজনের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছেন।
দোকানটা খুবই সাধারণ—
একটা টিনের ছাউনি, কাঠের বেঞ্চ, আর পুরনো ছেঁড়া ছাতায় ঢাকা কয়েকটা চেয়ার।
পেছনে গুটি গুটি শব্দে চলে ট্রেন, মাঝে মাঝে হুইসেলের আওয়াজে কথা থেমে যায় কয়েক সেকেন্ড।
আর মাঝখানে বসানো থাকে লুডু বোর্ড।
প্রতিদিন রাত ১০টা মানেই শুরু হয়—
নাম নেই, ব্র্যান্ডিং নেই, কিন্তু স্মৃতির ভাণ্ডার ভরপুর।
চা, সিগারেট, ঝালমুড়ি, আর বকবক—সবই চলে প্রতিদিন।
মানিক বলে, “ব্যবসা করছি ঠিক আছে, কিন্তু এই সময়টা না থাকলে পাগল হয়ে যেতাম।”
সোহেল হেসে বলে, “টাকার চাইতেও বড় জিনিস এই বন্ধুত্ব।”
আকাশ বলে, “অফিসের বস গালি দেয়, আর তোরা ভালোবাসিস, ব্যালেন্স হয়ে যায়।”
মুনির বলে, “তোদের পেয়েছি বলেই তো অফিসের বন্দী জীবন থেকে এখানে কিছুটা শ্বাস নিতে পারি।
একদিন, ঝড়ের রাত। চারদিক অন্ধকার, বিদ্যুৎ নেই।
তবুও একে একে সবাই আসে—ভিজে, কাঁপে, তবুও আসে।
চায়ের দোকান বন্ধ, রাস্তার পাশে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে সবাই।
তখন সোহেল বলে,
“দেখ, দোকান নাই, চেয়ার নাই, আলো নাই—তবুও তোরা আছিস।
এইটাই তো আসল বন্ধুত্ব। এইটাই তো জীবন।”
তখন মনে হয়,
জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো বোধহয় ঘড়ির কাঁটা দেখে না—হৃদয়ের সময় মেপে চলে।
চারজন বন্ধু চার পথে চলেছে, চার রকম জীবন বেছে নিয়েছে।
তবুও রাত ১০টার পর, তারা সবাই এক।
সেই একতা, সেই ভালোবাসা, সেই বন্ধুত্ব—চিরকাল অটুট থাকুক।