চাষী মামুন
বর্তমান বিশ্বে শিল্পোন্নয়ন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (Industry 4.0)। এই বিপ্লব কেবল একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ধারা নয়, বরং এটি বিশ্ব অর্থনীতিকে রূপান্তরের এক অসাধারণ যাত্রা। স্বাভাবিকভাবেই, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি — ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) খাত — এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমরা যদি সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নিই, তবে আমাদের SME খাত শুধু প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে না, বরং বাণিজ্য-শৃঙ্খলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিও থাকবে। আবার, সঠিক রোডম্যাপ ও সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে এই খাত হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির ভিত্তি।
৪র্থ শিল্প বিপ্লব: কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
Industry 4.0 মূলত ডিজিটাল প্রযুক্তির একীভূত প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন, সাপ্লাই চেইন ও ব্যবস্থাপনায় স্বয়ংক্রিয়তা, বুদ্ধিমত্তা এবং সংযুক্ততার মিশ্র রূপ। এর মূল উপাদানগুলো হলো:
> 𝗜𝗻𝘁𝗲𝗿𝗻𝗲𝘁 𝗼𝗳 𝗧𝗵𝗶𝗻𝗴𝘀 (𝗜𝗼𝗧)
> 𝗔𝗿𝘁𝗶𝗳𝗶𝗰𝗶𝗮𝗹 𝗜𝗻𝘁𝗲𝗹𝗹𝗶𝗴𝗲𝗻𝗰𝗲 (𝗔𝗜)
> 𝗥𝗼𝗯𝗼𝘁𝗶𝗰𝘀 & 𝗔𝘂𝘁𝗼𝗺𝗮𝘁𝗶𝗼𝗻
> 𝗕𝗶𝗴 𝗗𝗮𝘁𝗮 & 𝗔𝗻𝗮𝗹𝘆𝘁𝗶𝗰𝘀
> 𝗖𝗹𝗼𝘂𝗱 𝗖𝗼𝗺𝗽𝘂𝘁𝗶𝗻𝗴
> 𝗖𝘆𝗯𝗲𝗿-𝗣𝗵𝘆𝘀𝗶𝗰𝗮𝗹 𝗦𝘆𝘀𝘁𝗲𝗺𝘀 (𝗖𝗣𝗦)
> 𝗕𝗹𝗼𝗰𝗸𝗰𝗵𝗮𝗶𝗻 & 𝗖𝘆𝗯𝗲𝗿𝘀𝗲𝗰𝘂𝗿𝗶𝘁𝘆
এই প্রযুক্তিগুলো শুধু বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান নয়, বরং SME-দের জন্যও খরচ কমানো, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার দারুণ সুযোগ এনে দেয়।
তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতিতে আমাদের SME খাত অনেকগুলো কাঠামোগত ও নীতিগত চ্যালেঞ্জে জর্জরিত। যা মোকাবেলা ও উত্তরনে টেকসই এবং সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকে। এটা না করলে সামাজিক-অর্থনৈতিক (Socio Economic) বিপর্যয় রোধ করা যাবে না।
বাংলাদেশের SME খাতের চ্যালেঞ্জসমূহ:
১. প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাব:
বেশিরভাগ SME-তে এখনো ERP, CRM, IoT বা AI ব্যবহারের সক্ষমতা নেই। কারিগরি জ্ঞান এবং অবকাঠামো দুটোরই ঘাটতি রয়েছে।
২. মানবসম্পদের দক্ষতার ঘাটতি:
কর্মীদের Industry 4.0 প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হওয়ায় অটোমেশন বা ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন বাধাগ্রস্ত হয়।
৩. আর্থিক সীমাবদ্ধতা:
Digitalization এর প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের সহজলভ্যতা নেই। Collateral-based ব্যাংকিং প্রক্রিয়া SME-দের জন্য প্রতিবন্ধক।
৪. নীতিগত ও রেগুলেটরি সমস্যা:
নতুন প্রযুক্তির উপযোগী SME-friendly policy framework, incentive mechanism ও standard guideline এখনো সুস্পষ্ট নয়।
৫. নেটওয়ার্ক ও এক্সপোজারের ঘাটতি:
SME উদ্যোক্তারা আন্তর্জাতিক ট্রেন্ড, প্রযুক্তি ও জ্ঞান-ভিত্তিক হাবের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ফলত, গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত।
সম্ভাবনার দিগন্ত:
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সফল গ্রহণ বাংলাদেশের SME খাতে নিয়ে আসতে পারে এক বিপুল সম্ভাবনার জোয়ার; সেগুলো হলো:
Low-cost Automation এর মাধ্যমে উৎপাদন খরচ হ্রাস
AI ও Big Data ব্যবহারে Market Forecast ও Consumer Insight অর্জন
E-commerce ও Digital Platforms এর মাধ্যমে Global Customer Access
Green & Smart Manufacturing এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন
Skill-based outsourcing ও Freelance Economy তে SME-দের অংশগ্রহণ
বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও করণীয়:
A. 𝗗𝗶𝗴𝗶𝘁𝗮𝗹 𝗜𝗻𝗳𝗿𝗮𝘀𝘁𝗿𝘂𝗰𝘁𝘂𝗿𝗲 উন্নয়ন
সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে SME Tech Hub, Cloud Platform, Shared AI Tools ইত্যাদি সহজলভ্য করতে হবে।
B. 𝗦𝗸𝗶𝗹𝗹 𝗗𝗲𝘃𝗲𝗹𝗼𝗽𝗺𝗲𝗻𝘁 & 𝗧𝗲𝗰𝗵 𝗧𝗿𝗮𝗶𝗻𝗶𝗻𝗴
SME কর্মীদের জন্য IoT, AI, Data Science, Digital Marketing ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রোগ্রাম প্রয়োজন। National Skill Development Policy কে ৪IR-aligned করতে হবে।
C. 𝗜𝗻𝗻𝗼𝘃𝗮𝘁𝗶𝗼𝗻 & 𝗥&𝗗 𝗦𝘂𝗽𝗽𝗼𝗿𝘁
SME গুলোর জন্য Government-backed Innovation Grant ও Tech Adoption Voucher চালু করা যেতে পারে।
D. 𝗣𝗼𝗹𝗶𝗰𝘆 𝗥𝗲𝗳𝗼𝗿𝗺
SME digital transformation এর জন্য পৃথক নীতিমালা, ট্যাক্স ইনসেন্টিভ ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাবসায়ীদের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।
E. 𝗚𝗹𝗼𝗯𝗮𝗹 𝗖𝗼𝗹𝗹𝗮𝗯𝗼𝗿𝗮𝘁𝗶𝗼𝗻
SME-দের আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম, হ্যাকাথন ও বিজনেস ইনকিউবেটরে যুক্ত করার মাধ্যমে প্রযুক্তি স্থানান্তর ও রপ্তানিমুখী প্রস্তুতি বাড়ানো যেতে পারে।
বৈশ্বিকতাবোধ ও ব্যবসায়িক সক্ষমতা:
প্রযুক্তির এই যুগে, SME খাত আর কেবল একটি স্থানীয় উৎপাদন খাত নয় — বরং এটি হতে পারে বাংলাদেশের “Digital Export Economy”-র ভিত্তি। যেমন- ডিজিটাল হস্তশিল্প, AI-চালিত এগ্রি-টেক, ক্লাউড সার্ভিস, ক্রিয়েটিভ ও টেকনিক্যাল আউটসোর্সিং ইত্যাদি।
বড় কথা হচ্ছে SME-দের Global Value Chain-এ সংযুক্ত করতে না পারলে তারা আগামীর বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। তাই এখনই সময় — “Think Local, Act Global” মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে SME-দের প্রস্তুত করার। তবে সবার আগে দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসন, স্থিতিশীল ও ন্যায়ভিত্তিক সরকার ব্যবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা, নাগরিক ও বিনিয়োগ নিরাপত্তা, সরকারী কর্মচারী ও পদস্থ আমলাদের রাষ্ট্রভক্ত হওয়া এবং উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা বান্ধব মানবিক সিস্টেম প্রবর্তন নিশ্চিত করতে না পারলে কোন কিছুই অর্জিত হবে না।
উপসংহার
৪র্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের SME খাতের জন্য এক অভূতপূর্ব সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই ও জ্ঞাননির্ভর SME Ecosystem গঠনের জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস, প্রগতিশীল নীতিমালা এবং প্রযুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা জরুরি।
বাংলাদেশ এসএমই ফোরাম বিশ্বাস করে — “𝗗𝗶𝗴𝗶𝘁𝗮𝗹 𝗦𝗠𝗘𝘀”-ই হবে আগামীর অর্থনীতির নিউ ইঞ্জিন। তাই এখনই সময়, SME-দের প্রযুক্তির আলোয় আলোকিত করে ভবিষ্যতের শিল্পনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার।
লেখকঃ প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ এসএমই ফোরাম