লেখক: মুক্তাদীর মুন্না
রোদেলা সকাল। আকাশে হালকা মেঘের ভেলা, তার ফাঁক দিয়ে ছুঁই ছুঁই করছে বৈশাখের প্রথম রোদ। ঢাকার একটি নামী স্কুলের সামনের সড়কজুড়ে মানুষের ভিড়। আজ স্কুলের বৈশাখী উৎসব, আর তারই অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয়েছে শোভাযাত্রার। রঙিন পাঞ্জাবি, শাড়ি, মাথায় ফুলের মালা আর হাতে হাতের তৈরি পোস্টার-সব বয়সী মানুষজন এক উৎসবের জোয়ারে মেতে উঠেছে।
দশ বছরের রোহান আজ তার জীবনের প্রথম বড় চরিত্রে অভিনয় করছে, সে আজ রাজা! সোনালি মুকুট, হলুদ-লাল-নীল রঙের রাজকীয় জামা, কোমরে বেল্ট আর হাতে ছোট রাজদণ্ড। মঞ্চে ওঠার আগে মা রুনি তার টুপি একটু ঠিক করে দেয়। সাদা-লাল পাড়ের শাড়িতে রুনিও যেন যেন একদম মায়ের মতো লাগছে, যিনি নিজের সন্তানের রাজ্যাভিষেক দেখতে এসেছেন। পাশে বাবা রুদ্র ও মা রুনি দুজনেই বেসরকারী কর্মজীবি হওয়ায় তাদের একমাত্র সন্তান রোহানকে খুব বেশি সময় দিতে পারেন না। তাই আজ একসাথে বৈশাখী উৎসব উদযাপন করার সুযোগ হাত ছাড়া করেন নাই কেউ। রুদ্রের কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরায় ছেলের রাজা সাজার মুহূর্ত ধরে রাখছে নিঃশব্দে।
শোভাযাত্রা শুরু হয় ঢাক-ঢোলের তালে, রোহান হাঁটছে সবার সামনে। তার রাজকীয় ভঙ্গিতে হঠাৎ রুদ্র আবেগে ভেসে যায়। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অন্য এক দৃশ্য, একটি ভিন্নরকম শোভাযাত্রা নয়, বরং এক অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। ইতিহাসের মঞ্চ।
রুনি তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি ভাবছো এত গভীরভাবে?”
রুদ্র চোখ ফেরায়, তারপর নিচু গলায় বলে, “এই পহেলা বৈশাখের আনন্দে ডুবে থাকতে থাকতে আমরা প্রায় ভুলেই যাই, এই সময়টারই আশেপাশে একটা ঐতিহাসিক সুন্দর দিন ছিল, ১৭ এপ্রিল। যেদিন বাংলাদেশ একটা আনুষ্ঠানিক সরকারের রূপ পেল-মুজিবনগর সরকার।”
রোহান ততক্ষণে খেয়াল করে ফেলেছে বাবার গম্ভীর ভাব। সে চট করে বলে ওঠে,
“বাবা! বলো না, কি হয়েছিল সেদিন? তুমি তো ইতিহাস জানো!”
রুদ্র হেসে রোহানকে কোলে তোলে, রুনিকে পাশে বসায়। ছোট্ট এক ছায়াতলায় তিনজন বসে পড়ে বৈশাখের দুপুরে। তারপর রুদ্র শুরু করে এক নিঃশ্বাসে বলা ইতিহাসের সেই গল্প-
মুজিবনগর সরকার: এক স্বাধীন জাতির ঘোষিত ভিত্তি
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় চালানো হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হামলা-‘অপারেশন সার্চলাইট’। বহু ঘরবাড়ি পুড়ে যায়, ছাত্র, শিক্ষক, সাধারণ মানুষ হত্যা হয়। সেই রাতেই গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের পরও থেমে থাকেনি বাঙালি। স্বাধীনতার ঘোষণা আসে, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দেশের সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও একটা বড় সমস্যা ছিল-রাজনৈতিক নেতৃত্বহীনতা। একটি যুদ্ধ চলার জন্য শুধু সাহস নয়, দরকার নেতৃত্ব, পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
এই সংকটের সমাধান আসে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১।
স্থান: মেহেরপুর জেলার ছোট্ট গ্রাম বৈদ্যনাথতলা, পরবর্তীতে যার নামকরণ হয় মুজিবনগর।
আমবাগানে বাঁশ ও কাপড় দিয়ে তৈরি হয় অস্থায়ী মঞ্চ। আর সেই মঞ্চেই ঘোষণা করা হয়:
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হবেন রাষ্ট্রপতি (যদিও তখন তিনি বন্দী)।
২. সৈয়দ নজরুল ইসলাম হবেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।
৩. তাজউদ্দীন আহমদ হবেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
এই শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের কূটনীতিক রমেশচন্দ্র সেনাসহ আরও অনেকে। সীমিত পরিসরে হলেও এটি ছিল একটি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক জন্মের মুহূর্ত।
এই সরকারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি জোরালো হয়। ভারতসহ বহু দেশ বুঝতে পারে, এটি কোনো গেরিলা বিদ্রোহ নয়, এটি একটি জাতির সাংবিধানিক দাবি।
শপথ নেন:
সৈয়দ নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি)
তাজউদ্দীন আহমদ (প্রধানমন্ত্রী)
মন্ত্রিসভার সদস্য: এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, আবদুর রব সেরনিয়াবাত প্রমুখ।
বৈশাখে ইতিহাসের যোগসূত্র:
রোহান বিস্মিত হয়ে বলে, “বাবা, স্বাধীনতার ঘোষণা তো হয়েছিল ২৬ মার্চ, কিন্তু সরকার হলো ১৭ এপ্রিল! এতদিন পরে!”
রুনি কাঁধে হাত রাখে রোহানের, “এই ইতিহাস অনেকেই ভুলে গেছে, বাবা। কিন্তু এটা আমাদের দেশের জন্মের গল্প।”
রুদ্র ধীরে হেসে বলে,
“স্বাধীনতা শুধু যুদ্ধ নয়, রাষ্ট্র গঠনের গল্প। আর ১৭ এপ্রিল সেটা শুরু হয়েছিল। এই গল্পটা আমি শুধু তোমাদের প্রজন্মের জন্য লিখব, জানাতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।”
রোহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তাহলে আমার শোভাযাত্রা থেকে যদি কেউ এই গল্পটা জানে, সেটা কি ইতিহাসে রাজা হবার মতোই সম্মান?”
রুদ্র চমকে তাকায়। একটা বৈশাখী শোভাযাত্রা থেকে যে প্রশ্ন উঠে আসে, তা যেন ইতিহাসের নতুন পথ তৈরি করে।
শেষ কথা:
বৈশাখ মানেই শুধুই আনন্দ নয়, ইতিহাসের আলোকিত পথচলা।
১৭ এপ্রিল এখন আর কেবল পুরনো পাতার ইতিহাস নয়, বরং রোহানের চোখে সেটা হয়ে ওঠে বৈশাখের আরেক নাম “বৈশাখী নামা”।
কিন্তু রোহানদের গল্প এখানেই শেষ হয় না।
বাবা রুদ্র চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, “তোমাদের প্রজন্ম সত্যিই অনেক ভাগ্যবান, স্রষ্টা তোমাদের প্রজন্মের সামনে আবার এক সুযোগ দিয়েছেন, রোহান।”
“কীসের সুযোগ?” বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে রোহান।
রুদ্র বলেন, “তুমি জানো, ছত্রিশজুলাই গণঅভ্যুত্থান শুধু কোনো রাজনৈতিক ঘটনাই নয়। ওটা ছিল রাষ্ট্রীয় অন্যায়, বৈষম্য আর গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে লাখো মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ। ঠিক যেমন ১৯৭১ এ আমদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম চেয়েছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, ঠিক তেমনই এই অভ্যুত্থানের পর আবারও আমাদের সামনে এসেছে নতুন করে ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে বৈষম্যহীন মানবিক রাষ্ট্রগঠনের সুযোগ।”
রুনি হালকা গলায় যোগ করে, “সংবিধান, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংকিং ব্যবস্থা সবই বদলানোর সময় এসেছে। রোহানদের প্রজন্মই হয়তো সেই পরিবর্তনের নায়ক হবে।”
রোহান চুপ করে শোনে। তার রাজদণ্ড হাতে, সে যেন নতুন করে বোঝে- রাজা সাজার অর্থ শুধু শোভাযাত্রা নয়, দায়িত্ব নেওয়ার প্রতীকও বটে।
রুদ্র ধীরে হেসে বলে, “যেমন বৈদ্যনাথতলায় একদিন একটি অস্থায়ী মঞ্চ থেকেই গড়ে উঠেছিল স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তি, ঠিক তেমনই ছত্রিশজুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশে আবার গড়ে উঠতে পারে ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক এক নতুন রাষ্ট্র।”
রোহান তাকায় আকাশের দিকে। তার চোখে তখন ভাসে একটা স্বপ্ন-বৈশাখের তপ্ত রোদে সাদা-লাল রঙে রাঙানো এক নতুন দিনের।