মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ০২:৪১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম:
উদীয়মান নক্ষত্র সাহিত্য এ‍্যাওয়ার্ড ২০২৫, মনোনীত হলেন, কবি, প্রভাবশালী কলামিস্ট ও রাষ্ট্রচিন্তক অথই নূরুল আমিন সাংবাদিক মামুন রেজার চলে যাওয়া: এ যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের আকস্মিক পতন কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার কর্তৃক কুষ্টিয়া মডেল থানা বার্ষিক পরিদর্শন হরিণটোনা থানা পুলিশের বিশেষ অভিযানে জাহিদুর হাওলাদার হত্যাকান্ডে জড়িত ৫ জন গ্রেফতার গোয়াইনঘাটে এফআইভিডিবির সুফল প্রকল্পের সমাপনী কর্মশালা অনুষ্ঠিত পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা: বিশ্ববাসীর করণীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় শান্তিগঞ্জে কাজ করতে চায় তরুণরা কবিতাঃ মনের সাধ গোপালপুরে কাব কার্ণিভাল ২০২৫ উদযাপন সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য শাহজাহান শাজুকে সম্মাননা স্মারক প্রদান

সাংবাদিক মামুন রেজার চলে যাওয়া: এ যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের আকস্মিক পতন

Coder Boss
  • Update Time : সোমবার, ২৩ জুন, ২০২৫
  • ২১ Time View

লেখকঃ অ্যাডঃ মোঃ বাবুল হাওলাদার

মামুন রেজাকে শেষ বিদায় জানানোর পর থেকেই তাঁকে নিয়ে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছিলাম। কিন্তু নানান ব্যস্ততাঁর কারণে হয়ে ওঠেনি। সময়ের ব্যবধানে মনের তাগিদটা আরো বেশী বাড়তে থাকে। যে কারণে কিছুটা বিলম্বে হলেও অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টা মাত্র।

সময়টা সম্ভবত ১৯৯৮ সালের কোনো এক সন্ধ্যা। দৈনিক জনবার্তা অফিসে মামুন রেজার সাথে প্রথম পরিচয়। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন এবং নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’র একজন কর্মী। সাংগঠনিক কাজের সূত্র ধরেই তাঁর সাথে পরিচয়। সদালাপী, মৃদুভাষী, সদা হাস্যোজ্জ্বল এ মানুষটির সাথে প্রথম পরিচয়েই আমি তাঁর প্রতি সম্মোহিত হয়ে পড়ি। কাজের সূত্র ধরেই গড়ে উঠতে থাকে সখ্যতা, ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব এক নিবিড় সম্পর্ক। আমি এক সময়ের ছাত্র ও যুব আন্দোলনের পরবর্তীতে রাজনৈতিক কর্মী এবং নাগরিক ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী হিসাবে এবং মামুন রেজা একজন মাঠের পেশাদার, অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সাথে যোগাযোগ, কথাবার্তা, দেখা সাক্ষাৎ হতো প্রায়শই তাঁর পেশাগত কারণেই অধিকতর সাক্ষাৎ হতো বৈকি। মানবিক মানুষ হিসেবে মামুন রেজার কাছে তাঁর আত্মীয়-স্বজন বিশেষতঃ এলাকার মানুষ প্রায়শই আসতেন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। আইনগত কোন বিষয় হলে আমাকে ফোন করতেন মাঝে মধ্যেই। প্রয়োজনে অনেককে পাঠিয়ে দিতেন। চেষ্টা করেছি বন্ধুত্বের সম্পর্কের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে সমস্যার সমাধান করতে। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে বলা চলে প্রতি সপ্তাহেই ২/১ বার দেখা হতো মুলত চ্যানেল ২৪ এর নিউজের স্বাক্ষাতকারের জন্য। সমকালের নিউজ কমেন্টের জন্য মোবাইলে কথা হতো মাঝে মধ্যেই। দেখা হলে তাঁর পেশাগত কাজের শেষে শত ব্যস্ততাঁর মধ্যেও চা পান, গল্প হতো সব সময়ই। পেশা, রাজনীতি, দেশের পরিস্থিতি, খুলনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা যার মধ্যে স্থান পেত ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ও। মামুন রেজা ৪৫ বছরের ক্ষণজীবনে খুলনা প্রেসক্লাবের চারবার সাধারণ সম্পাদক, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের (কেইউজে) দুইবার সভাপতি, কাজ করেছেন দৈনিক যুগান্তরে তাঁর আগে দৈনিক জনবার্তা, দৈনিক জন্মভূমি, সান্ধ্যকালীন দৈনিক রাজপথের দাবী, সর্বশেষ দৈনিক সমকাল, চ্যানেল ২৪ এবং দৈনিক পূর্বাঞ্চলের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে। প্রেসক্লাব এবং ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে রাজনৈতিক বা আদর্শিক মেরুকরণে কিংবা প্রেস পলিটিক্স এর সমীকরণে সংগত কারণেই তাঁর সাথে অনেকের মতপার্থক্য হলেও সেটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুব একটা গড়ায়নি বলেই জানি। যদিও ভিন্নমত গণতন্ত্রের বৈচিত্র, সৌন্দর্য, এটিই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। তাঁকে দলবাজিতে কঠোর হতে দেখিনি কখনো। আমার সাথেও তাঁর আদর্শিক বা রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল কিন্তু তাঁর পেশাদারিত্ব, আচরণ, ব্যবহার, আন্তরিকতা সবকিছুকেই ছাপিয়ে দিয়েছে সব সময়। দল বা মতের কট্টর মানুষ হওয়ার চেয়ে একজন ভালো মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টা ছিল সম্ভবত তাঁর সব সময়ই। মামুন রেজা বয়সে আমাদের সমসাময়িক কিন্তু তাঁর কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই।

 

রাজধানী শহর কেন্দ্রিক বাংলাদেশে ঢাকার বাইরে থেকে পেশাগত জায়গায় তাঁর যে অর্জন বয়সের তুলনায় সেটি সর্বোচ্চ বলা যায়। একদিকে যেমন সাংবাদিক সংগঠনের খুলনার শীর্ষস্থানে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন একই সাথে দেশের স্বনামধন্য দুটি জাতীয় গণমাধ্যমে কাজ করেছেন সুনাম ও দক্ষতাঁর সাথে। মানুষের অবস্থান তৈরি হওয়ার সাথে সাথে অনেকেরই চলন-বলন বদলে যায় রাতারাতি। কিন্তু মামুন রেজা ছিলেন ঠিক তাঁর উল্টোটা। তিনি পেশাগত জীবনে যত বেশী অর্জন করেছেন ততই বেড়েছে বিনয়, দায়িত্ববোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আরো বেশি পেশাগত উৎকর্ষতা সাধনের প্রচেষ্টা। তিনি গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাননি কখনোই। সততা আর নিষ্ঠা ছিল তার সাংবাদিকতার মূল পুঁজি, ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান সংগঠকও। মামুন রেজা ছিলেন রসিক মানুষ কিন্তু তাঁর রসিকতা ছিল নির্ভেজাল। তাঁর রসিকতা বা কথাবার্তায় কখনো কেউ কষ্ট পেয়েছেন এমনটা জানা নেই। তার কোন তীর্যক বাক্যে কেউ কখনো কষ্ট পেয়েছেন এমনটা হতে দেখিনি কখনো। বরং অনেকেই আনন্দ খুজতেন তাঁর মৃদু মৃদু রসিকতার মধ্যে।

 

২০ জুন রাত আনুমানিক ৯ টার দিকে তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পারি আমার আরেক প্রিয়ভাজন সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান মুন্নার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে। মুহুর্তের মধ্যে স্তব্দ হয়ে গেলাম। বার বার পড়ছিলাম স্ট্যাটাসটি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কোন মতেই। যে মামুন রেজা সংবাদ পৌঁছে দিতেন দেশবাশীর কাছে সে মামুন রেজাই নিজেই সংবাদ হয়ে গেলেন? যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম অনেকের সাথে কাউকে ফোনে পেলাম না। যাকেই ফোন করি সেই ব্যস্ত অন্য কলে। আমার চেম্বার জন্মভূমি ভবনের ২য় তলায় হওয়ায় একই ফ্লোরে দৈনিক জন্মভূমি অফিস। ছুটে গেলাম বার্তা সম্পাদক বন্ধুবর ইয়াছিন আরাফাত রুমির কাছে। জানতে পারলাম সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে তাঁর মরদেহ। কথা হলো একসাথে যাবো। সাথে সাথেই অন্য একটি কলে (নামটা মনে করতে পারছিনা) জানতে পারলাম মরদেহ বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। সাথে থাকা লোকজন নিয়ে দ্রুত চলে গেলাম মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বে মামুন রেজার বাসার নিচ তলায়। দেখলাম প্রিয় মামুন রেজার নিথর দেহ। তাঁকে ঘিরে তাঁর স্বজনদের আহাজারী, তাঁর বড় ভাই মাসুদ রানা এবং লীজা ভাবীর আহাজারীতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছিল। তাঁর একমাত্র সন্তান অবুঝ জাওয়াদের অপলক দৃষ্টি, অস্ফুট হাহাকার, নিস্তব্ধতা, সহকর্মীদের কান্না, চোখের পানি আর আষাঢ়ের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি মিলেমিশে তৈরী হয়েছে এক গভীর বিষাদময় পরিবেশ। আষাঢ়ের শ্রাবণী ধারাও জেন জানান দিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিও কাঁদছে দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রিয় খুলনার সাংবাদিকতার বিশেষ করে তরুণ সাংবাদিকদের বাঁতিঘর, মৃদুভাষী, বিনয়ী, বন্ধুবৎসল, সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল, পরোপকারী, মানবিক, প্রতিশ্রুতিশীল, অদম্য, এক অনন্য চরিত্রের অধিকারী মামুন রেজার চির বিদায়ে। সেখানে দাঁড়িয়ে বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছিলাম। নিজের অজান্তেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। কিছুক্ষণ পর পর দীর্ঘশ্বাস। বার বার মানষপটে ভেসে আসছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি মৃদু ও মিস্টি হাসি ভরা মুখখানা। অপেক্ষা করছিলাম প্রথম নামাজে জানাজার জন্য। রাত সাড়ে ১২টার দিকে জানাজা শেষে তাঁর মরদেহের সাথে গেলাম তাঁর প্রিয় কর্মস্থল খুলনা প্রেস ক্লাবে। শেষবারের মতো তাঁর সহকর্মীরা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে নিয়ে গেলেন সেখানে। অশ্রুজলে ধুয়ে-মুছে অতীতের সব মান-অভিমান-ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটালেন মামুন রেজার সাথে। চলে গেলেন প্রিয় মামুন রেজা। আর কোন দিন মামুন রেজার ফোন আসবে না। “ভাই কোথায় আছেন, একটা ইন্টারভিউ দরকার ছিল।” “ভাই একটা লোক পাঠাবো একটু আইনী পরামর্শ দিবেন।” “একটা নিউজে আপনার একটা কমেন্ড দরকার।” “তুষারকে পাঠাচ্ছি, ও ফোন দিবে।” মানুন রেজার গণমাধ্যম এবং খুলনার উন্নয়ন, সমাজের অসঙ্গগতি ইত্যাদি বিষয়ে দেওয়ার ছিল অনেক কিছুই। সুন্দরবন, পরিবেশ, জীববৈচিত্র, নাগরিক সমস্যা, উন্নয়নে খুলনার প্রতি বৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ছিলেন সব সময় সরব। তাঁর চলে যাওয়ায় যেমন অপূরনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হলো তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, এলাকার মজলুম মানুষ, অভিভাবক হারা হলো জাওয়াদ, তাঁর সহকর্মীরা হারালেন একজন প্রিয় সতীর্থ, শিক্ষাগুরু, নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল, বিশ্বস্ত বন্ধু। তেমনি দেশ তথা খুলনা অঞ্চল হারালো একজন সম্ভাবনাময়ী-উদীয়মান-তরুণ গণমাধ্যম কর্মীকে। প্রিয় মামুন রেজা আপনি যা দিয়ে গেলেন, তা ভুলবার নয়। আপনাকে মনে পড়বে প্রতিটি কাজের মধ্যে, হয়তো আমৃত্যু। যেখানে থাকবেন ভালো থাকবেন, অনেক ভালো প্রিয় মামুন রেজা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102