মো: রুহুল আমিন (রকি)

আজকের শহরের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যানজট। আর শহরের সঙ্গী হয়ে যেন তা আমাদের জীবনের এক অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। সকাল-বিকেল, অফিসের সময় কিংবা বিকেল ছুটির পর-যানজট তো ছিলই, এখন তীব্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এর সমাধানে কিছু করতে পারছি?

শহরের রাস্তা এখন এক অস্থির এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে উঠেছে, যেখানে গাড়ি, বাইক, রিকশা, বাস, ট্রাক সব কিছু একসাথে চলে, অথচ যেন কোথাও থামছে না। মনে হয়, রাস্তার উপর একটা অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে, যেখানে প্রতিটি গাড়ির ড্রাইভার নিজেকে প্রথমে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতায় নিয়ে চলেছে। প্রতিটি ইঙ্গিত, প্রতিটি মুহূর্ত-একটি দ্রুত গতির দৌড়।

আমরা কেন এই পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছি?

১. জনসংখ্যার আধিক্য:

শহরের জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে-নতুন মানুষ আসছে, নতুন আবাসন তৈরি হচ্ছে, নতুন অফিস গড়ে উঠছে। কিন্তু শহরের পরিকাঠামো এতটুকু উন্নত হয়নি। সেই কারণে নতুন রাস্তা, ব্রিজ বা মেট্রোর মতো সিস্টেমের সংকট বাড়ছে। ফলে একটি মাত্র সড়ক দিয়ে একে একে সবাই চলতে থাকে, আর সেই চলাচলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যানজট।

২. যানবাহনের সংখ্যা:

গাড়ির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর রাস্তায় স্থান অনেকটাই সীমিত। এখানে একটা মজার বিষয় হলো-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা শুনতাম, গাড়ি কমালে যানজট কমবে, কিন্তু এখন কী দেখছি? সবার হাতে ব্যক্তিগত গাড়ি, অথচ কোন সিস্টেম নেই, রাস্তা ব্যবস্থাপনাও অপর্যাপ্ত। এই ভাবে গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো মানেই অতিরিক্ত জ্যাম!

৩. সড়ক নকশার অব্যবস্থাপনা:

একদিকে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে, অন্যদিকে সেই রাস্তার নকশায় অদক্ষতা কিংবা অগ্রিম পরিকল্পনার অভাবও এক বড় কারণ। এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা গতি রোধ করছে, রাস্তার পাশে পার্কিং সমস্যা, পথচারী চলাচলের জন্য যথেষ্ট জায়গা নেই-এইসব কারণে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।

৪. পরিবহনের অভাব:

মেট্রো, বাস, সাইকেল লেন-যত নতুন উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা আসছে, ততই তার সংকট বাড়ছে। একদিকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, অন্যদিকে যানবাহন কম থাকে। ফলে বেশিরভাগ মানুষ আবার নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হন, যা যানজট আরও বাড়ায়।

সমাধানের পথ কী?

যানজট নিরসনে একমাত্র সঠিক সমাধান পরিবহন ব্যবস্থার সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। মেট্রো, বাস, ট্রেনের মতো গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করা, রাস্তায় যানবাহনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা, সাইকেল লেনের মতো নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং আধুনিক শহর পরিকল্পনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনও করতে হবে-যানজটের মধ্যে পেশাদারি, ধৈর্য ও সৌজন্য বজায় রাখার প্রয়োজন।

শেষ কথা:

এখন সময় এসেছে, আমরা যেন শুধুমাত্র বাইরের শহরের যন্ত্রণা দেখতে না দেখি, বরং নিজের জীবনেও একটু পরিবর্তন আনতে পারি। শুধু অফিসে পৌঁছানোর তাড়া নয়, বরং একটু ভাবুন, একটু দাঁড়িয়ে যান, একটু শ্বাস নিন-কারণ জীবন শুধু গন্তব্য নয়, মাঝের পথও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন আমাদের শহরের রাস্তাগুলোতে চোখ বন্ধ করেই বাস চালানো যেন কোনো দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানজট এখন এক ধরনের অভিশাপ যা শুধু আমাদের সময় নষ্ট করে না, বরং মানসিক চাপও বাড়িয়ে দেয়। অফিসে যেতে আর কাজ শেষ করতে এই যানজট আমাদের দিনের মূল্যবান সময় চুরি করে নিচ্ছে।
যানজটের মূল কারণ হলো নগর পরিকল্পনার অভাব, যানবাহনের অতিরিক্ত সংখ্যা এবং অপরিকল্পিত রোড নেটওয়ার্ক। পাশাপাশি, রাস্তা জুড়ে অযথা পার্কিং, রাস্তা দখলকারী যানবাহন এবং যানবাহন চালকদের অসতর্কতা এই সমস্যা আরো বাড়িয়ে তোলে। ফলে, শহরের ব্যস্ততম সময়গুলোতে গতি যেন পুরোপুরি থেমে যায়।
যানজট শুধুমাত্র আমাদের সময় নষ্ট করে না, পরিবেশ দূষণও বাড়ায়। যানবাহনের ধোঁয়া, শব্দ দূষণ ও বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাসের মাত্রা বেড়ে যায়, যা স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জন্য এই পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক।
সমাধান অবশ্যই রয়েছে। জনপরিবহনের উন্নতি, সাইকেল বা হাঁটার মতো বিকল্প ব্যবস্থার প্রচার, সঠিক ট্রাফিক আইন প্রয়োগ এবং সচেতনতার মাধ্যমে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নগর পরিকল্পনায় আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে যাতে রাস্তাগুলোতে যানবাহনের চাপ কমে।
শহরকে বাঁচাতে, আমাদের সবাইকে অবশ্যই নিজেদের ভুমিকা নিতে হবে। যানজট কমাতে যদি সবাই একটু সচেতন হয়, পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবহার করে, আর যানবাহন চালানোর সময় ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলে — তাহলে যানজট আর সারা দিনের ক্লান্তি আমাদের জীবন থেকে বিদায় নেবে।