কলমেঃ মিটুল কুমার বোস
দরজার ফাঁক গলে ভোরের আলো ঢোকে,
যেমন জীবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে নিরব দায়িত্বের গ্লানি।
রান্নাঘরে হাঁড়িতে ফুটছে ডাল,
স্কুলব্যাগে জল ঢুকছে,
পলিথিন মোড়ানো ঘুম এখনও মায়ের চোখে।
বাবার চোখ খবরের কাগজে,
কিন্তু মন পড়ে থাকে মাসের শেষে হিসাবপত্রে।
রিকশায় উঠছে ছোট্ট বাচ্চাটা,
চুল বাঁধছে মেয়ে আয়নার সামনে—
সবাই যেন একেকটা দৃশ্যের নীরব অভিনয়শিল্পী।
এই মুহূর্তটাই মধ্যবিত্ত।
না আছে নাটকীয় উচ্ছ্বাস,
না অমোচনীয় শোক।
আছে কেবল এক চাপা শব্দহীনতা,
যা প্রতিদিন ভাঙে আবার জোড়া লাগায়—
নিঃশব্দে।
আমরা স্বপ্ন দেখি,
তবে দাঁড়াতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠি।
একটা চাকরি আঁকড়ে থাকি,
কেননা সন্তানের স্কুল ফি দিতে হয়,
বাবা-মায়ের ওষুধ কিনতে হয়,
বাজারের হিসাব মেলাতে হয়।
আমাদের ‘না’ বলার স্বাধীনতা নেই।
আমাদের দুঃখ প্রকাশের অবকাশ নেই।
আমাদের অভিমান করার সময় নেই।
আমরা গল্পে থাকি না, বিজ্ঞাপনে জায়গা পাই না,
কবিতায় আমাদের কেউ বাঁধে না।
আমরা টিকে থাকি,
নিজেদের মতো করে বাঁচতে শিখিনি।
আমরা নতুন জামার বদলে পুরনোটাই আয়রন করি।
নিমন্ত্রণে যাওয়ার আগে হিসাব করি—
ভাড়া কত, উপহার কী, শাড়িটা রঙচটে গেছে কি না।
আমাদের চোখে স্বপ্ন থাকে,
কিন্তু ঠোঁটে ধুলোর স্বাদ।
আমরা চুপচাপ সহ্য করি,
যেন সেটাই একধরনের আত্মসম্মান।
আমরা ঘুষ নিই না,
তবু বেতন দিয়ে মাস টানে না—
তবুও হাল ছাড়ি না।
আমরা আন্দোলন করি না,
তবু গোপনে এক বিদ্রোহ বয়ে বেড়াই।
আমরা ধর্মের নামে বিভাজন চাই না,
তবু মন্দির-মসজিদের মাঝখানে হাঁটতে গিয়েও কেঁপে উঠি।
তবু আমাদের এই নিঃশব্দ দায়বদ্ধতারও একটা আলো আছে।
এই আমরাই—
রাত জেগে সন্তানের স্বপ্ন বানাই,
ভাঙা সংসার জোড়া দিই,
নিজের স্বপ্ন ভুলে যাই।
তবু জানি—এই পৃথিবীটা আমাদের কাঁধেই দাঁড়িয়ে।
আমরা হারি না, কেবল পিছিয়ে থাকি।
আর পিছিয়ে থেকেও এগিয়ে নিয়ে যাই সবকিছু।
আমাদের নাম মধ্যবিত্ত।
আমরা ভাঙা চেয়ার ঠিক করি,
ফাটা স্বপ্ন সেলাই করি।
আমরা দারিদ্র্য আর বিলাসের মাঝখানে
এক চাপা আর্তনাদ হয়ে থাকি—
যা মুখে আসে না,
তবু বুকের মধ্যে বাজতেই থাকে।
তবু আমরা বাঁচি—
অসীম এক আত্মসম্মান নিয়ে।
কারণ আমাদের জীবন কেবল বাঁচার নয়—
একটা দায়বদ্ধতা।