সরকারের কিছু অসাধু আমলা, বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক রাষ্ট্রদ্রোহী এনজিও ও স্বল্প সংখ্যক আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (আইএনজিও) অপ তৎপরতার কারণের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দিন দিন জটিল হয়ে উঠেছে। এসব দেশদ্রোহীরা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরতে নিরুৎসাহিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এই অসাধু সিন্ডিকেট রোহিঙ্গাদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে এবং তাদের বাংলাদেশে রেখে দেওয়ার জন্য নতুন ক্যাম্প নির্মাণ করছে।
আমি মনে করি, যেসব কারণে প্রত্যাবাসনে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, তারমধ্যে অন্যতম কারণ কিছু এনজিও ও আইএনজিও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে দিয়ে দাতা সংস্থার অর্থ লুটপাট চালিয়ে যেতে চায়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হলে তাদের কার্যক্রম ও অর্থপ্রাপ্তি বন্ধ হয়ে যাবে। কিছু সংস্থা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে প্রভাবিত করে এবং তাদের দেশে ফিরতে অনাগ্রহী করে তোলে। তারা রোহিঙ্গাদের জানায় যে, তারা দেশে ফিরে নিরাপত্তা ও অধিকার পাবে না। কিছু এনজিও এলাকায় নতুন করে ক্যাম্প তৈরি করে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য ঘর নির্মাণের নামে পাহাড় কাটছে, যা থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিছু সংস্থা মানবিক কারণ দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে চাইছে, যা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। রোহিঙ্গা শিবিরে থ্রিজি, ফোরজি ইন্টারনেট সেবা রাতে বন্ধ রাখা হচ্ছে, যাতে রোহিঙ্গারা বাইরের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে না পারে এবং তাদের উপর থাকা সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে।
এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে সহজ করতে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। সংকটটি মূলত মিয়ানমার সরকারের নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তার কারণেও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। গোয়েন্ধা তথ্যের ভিত্তিতে দেশদ্রোহী অভিযুক্ত এনজিও এবং আইএনজিওগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও আর্থিক লেনদেন স্থগিত করা একান্ত জরুরি । প্রত্যাবাসন বিরোধী ও রোহিঙ্গাবান্ধব অসাধু সরকারী কর্মকর্তাদের কক্সবাজার হতে প্রত্যাহার করে কঠোর শাস্থির আওতায় নিয়ে আসা হোক, কারণ তাদের কার্যকলাপ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা সৃষ্টি করছে এবং তাদের শ্রেণিস্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে, এনজিও ও আইএনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের সহায়তা ও সুরক্ষার নামে মানবিক সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের আড়ালে দেশবিরোধী তথা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। আমি সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি এনজিওগুলোর কার্যক্রম তদারকি করার সুপারিশ করেছি। সেই সাথে এনজিও ও আইএনজিওদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার জন্য তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ বা অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। বরং রোহিঙ্গা ঢলকে কিছুটা স্বাগত জানিয়েছিল মাদার অব হিউম্যানিটির আড়ালে নোভেল প্রাপ্তির হীন লোভে। আশার বিষয় যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রত্যাবাসন ইস্যুটি নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে এজেন্ডা এগিয়ে নেওয়ার জন্য একাধিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল বাড়ানো এবং তাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ জোরদার করতে চলতি আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুতে ৪টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘অংশীজন সংলাপ’ নামে প্রস্তুতিমূলক একটি সম্মেলন আজ ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সম্মেলনের পর ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ফাঁকে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হবে রোহিঙ্গাবিষয়ক আরেকটি উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন। এ ছাড়া, কাতারের দোহায় ৬ ডিসেম্বর আয়োজিত হবে তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। আসন্ন সম্মেলনগুলোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের একটি স্থায়ী ও প্রকৃত সমাধান খোঁজার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে।
আমি কার্যকর প্রত্যাবাসন অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত নিম্নলিখিত সুপারিশগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। আর একজন রোহিঙ্গাও যেন বাংলাদেশে নতুনভাবে প্রবেশ না করে। সব এনজিও হতে কর্মরত রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে স্থানীয়দের চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে, মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া, অবৈধ এনআইডি ধারীদের চিহ্ণিত করে বাতিল করাতে হবে ।
সময়মতো তহবিল নিশ্চিতকরণ : আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ নিশ্চিত করতে হবে এবং সময়মতো প্রতিশ্রুত তহবিল ছাড়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।
আশ্রয়ের নিরাপত্তা বৃদ্ধি: ক্যাম্পের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমানো এবং আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোধে বিদ্যমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে আরও টেকসই কাঠামো, যেমন কংক্রিটের দেয়ালে উন্নীত করার বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা যেতে পারে।
জীবিকাভিত্তিক কর্মসূচিতে সহায়তা বৃদ্ধি: বিভিন্ন বয়সের গোষ্ঠীর জন্য স্বল্প ও মাঝারি মেয়াদি আয়ের সুযোগ তৈরি করতে মুরগি পালন, মেকানিক কাজ, দর্জি, হস্তশিল্প, বাঁশের তৈরি সামগ্রী, মাছ ধরার জাল তৈরি, পোশাক উৎপাদন ও গৃহস্থালি বাগান করার মতো কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণমূলক প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এসব দক্ষতা ভবিষ্যতে তাদের নিজ দেশে ফেরার পরও কাজে লাগবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা বিধান: যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি থেকে ক্যাম্পগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে, যেকোনো সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি ও উপস্থিতি আরও জোরদার করা প্রয়োজন।
প্রত্যাবাসনই টেকসই সমাধান: পরিশেষে, রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর সমাধান হলো স্বেচ্ছাসেবী, মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান : জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক মানবিক সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে যে, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো সমস্যা নয়। এটি মূলত আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং দীর্ঘদিনের জাতিগত সংঘাতের ফল। রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জাতিগত নিপীড়ন, ধর্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের শিকার। তাদের প্রতি সুবিচার অস্বীকার করা মানে ইতিহাসের অবিচারকে আরও তীব্র করা। রোহিঙ্গা সংকট কেবল একটি মানবিক জরুরি অবস্থা নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী সংহতির একটি পরীক্ষা। জরুরি তহবিল, শিক্ষা ও সুরক্ষা ছাড়া হতাশা তাদের জীবনের অংশ হয়ে যাবে এবং অস্থিতিশীলতা সীমান্ত পেরিয়ে আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যাবাসনই এই সংকটের একমাত্র টেকসই সমাধান। এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: মহাসচিব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম জাতীয় কমিটি ও চেয়ারম্যান পালংখালী ইউনিয়ন, পরিষদ, উখিয়া, কক্সবাজার।