মুহাম্মদ আতা উল্লাহ খান
ছাত্রজনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানোত্তর সময়েও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনে বিগত সরকারের মতই দায়সারা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো নজরুলের জন্মজয়ন্তী ও মৃত্যু দিবসে নামেমাত্র ছোট্ট পরিসরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না। এ দেশে নজরুল চর্চাকে যতটুকু সম্ভব চাপা রাখা যায়, নজরুলের দর্শনকে যেভাবেই হোক যতটুকু দমিয়ে রাখা যায়- এ প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
নজরুল তাঁর কর্মময় জীবনের সিংহভাগ অতিবাহিত করেছেন পেশাদার সাংবাদিকতায়। অথচ গণমাধমেও তিনি উপেক্ষিত থাকেন জন্মজয়ন্তী কিংবা মৃত্যুবার্ষীকিতে। জাতীয় কবির সমাধীতে তেমন দেখা যায় না ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক ও সামজিক সংগঠনগুলোকে শ্রদ্ধা জানাতে। সারাদেশে তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ে না নজরুল উৎসব, নজরুল সংগীত ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, স্মরণ সভা কিংবা আলোচনা সভাও।
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সাড়ম্বরে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নির্দেশনা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এটা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছিল, ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে ও সাড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা বিভাগ, কারিগরি মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। চমৎকার ও নিখুঁত আয়োজনে উদযাপিত হলো এবারের বৈশাখ।’
কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্বপ্নদ্রষ্টা ও ২৪ গণঅভ্যুত্থানে যার গান, কবিতা ও বাণী অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল, বাংলাদেশের জাতীয় কবির জন্মদিন পালনে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের মত এত দায়সারা গোছের কেন? সরকার, গণমাধ্যাম ও নজরুলচর্চাকারী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের কোন কার্যকরী উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের শরীক ছাত্র সংগঠন, (কবি নজরুলের ভাষায় ছাত্রদল) রাজনৈতিক দল ও নজরুলচেতনা ও দর্শনে বিশ্বাসী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কি ভুলে গেল জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী পালনের কথা? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে শুয়ে যিনি তাঁর, গান, কবিতা ও বাণীতে শাহবাগ চত্বরকে শুধু নয় পুরো দেশকে জাগ্রত রেখেছিলেন, তার নাম কাজী নজরুল ইসলাম।
২০২৪ সালে দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের অন্যায়, অবিচার আর দুঃশাসনের বিপরীতে ছাত্রজনতার যে অভ্যুত্থান হলো, সেখানেও নজরুল হয়ে ওঠেন প্রতিবাদী প্রেরণার উৎস। ধর্ম-বর্ণ, মত-পথ ও ব্যবসায়-পেশা ব্যতিরেকে সব প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে নজরুলের কবিতা ও গান। ভার্চুয়াল মাধ্যমে, পোস্টারে, প্লেকার্ডে, দেয়াল লিখনে ও গ্রাফিতিতে নজরুলের প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী বাণীগুলো যেন ইট-পাথরকেও জাগিয়ে তোলে। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ। সর্বাত্মক আন্দোলনের মুখে পতন হয় স্বৈরাচারী সরকারের। জনতার আক্রোশের মুখে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সপরিবারে ও সদলবলে পালিয়ে যান স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে সূচিত হয় নজিরবিহীন এক গণঅভ্যুত্থানের।
এই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রজনতার বিপ্লবী চেতনাকে শাণিত করেছে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান। মিছিল ও সমাবেশে আবৃিত্ত করা হয় তাঁর কবিতা, গাওয়া হয় তাঁর বিপ্লবী গান। তাঁর কবিতা ও গানে ছাত্রছাত্রীরা যেমন প্রেরণা লাভ করে, তেমনি পেশাজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ এমনকি নারীরাও উৎসাহিত হয় এই আন্দোলনে যোগ দিতে। ঘটনা বিশ্লেষেণ এবং দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি ও সোস্যাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই, এই গণঅভ্যুত্থানে নজরুলীয় চেতনা জুড়ে আছে অনেকখানি। ‘২৪’-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রছাত্রীরাই ছিল মূল চালিকাশক্তি। কোমলমতি স্কুল শিক্ষার্থীরাও স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে আত্মোৎসর্গ করে সেই আন্দোলনে। দেশজুড়ে তাদের জাগরণ আর আত্মোৎসর্গের পেছনে আমরা খুঁজে পাই নজরুলের চেতনা- বল বীর/বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
দেয়ালে দেয়ালে চোখে পড়ে নজরুলের কলমে দেয়াল লিখন- মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল বক্ষে ভরা বাক্, কন্ঠে মোদের কুন্ঠাবিহীন নিত্য কালের ডাক। আমরা তাজা খুনে লাল করেছি সরস্বতীর শ্বেত কমল। আমরা ছাত্রদল॥ [ছাত্রদলের গান]
সরকার বিরোধী ‘২৪’-এর আন্দোলনে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের উপরেও চালিয়েছে সীমাহীন নির্যাতন। তারা প্রকাশ্য দিবালোকে তাদেরকে রাজপথে মেরে রক্তাক্ত করেছে। শ্লীলতাহানী করেছে। গুম করেছে। হত্যা করেছে। তখন নারী-পুরুষ ভেদে আন্দোলনকারীরা প্রেরণা খুঁজেছে নজরুলে। দেয়ালে দেয়ালে দৃশ্যমান তাদের সে প্রেরণার আঁচড়- জাগো নারী, জাগো বহ্নি-শিখা। জাগো স্বাহা সীমান্তে রক্ত-টিকা॥ [গান: জাগো নারী]
দেয়াল লিখনে আরও চোখে পড়ে, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ আন্দোলনকারীরা ভাষা খুঁজে পান নজরুলে- ‘গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। [মানুষ] নতুন পথের যাত্রাপথিক চালাও অভিযান, উচ্চ কণ্ঠে উচ্চার আজ মানুষ মহীয়ান। [অভিযান] ছাত্র-যুবাদের সম্মিলিত জাগরণে আমরা শুনতে পাই, নজরুলের গান-দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার! দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত? কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ, এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!’ [কাণ্ডারী হুঁশিয়ার]
এই আন্দোলন দমাতে হাজার হাজার ছাত্রজনতাকে আটক করে জেলে পুরে রাখে স্বৈরাচারী সরকার। কিন্তু সে জেল জুলুমেও অকুতোভয় বিপ্লবীরা। তাই তো শিকল পরেও শিকল ভাঙার গানে অভ্যুত্থানকারীদের প্রেরণায় আমরা পাই নজরুলকে- ‘এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল-পরা ছল, এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।’
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের আন্দোলনে সব সময়ই উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছেন স্বাধীনতাকামী ও নিপীড়ন বিরোধী বুদ্ধিজীবীরা। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, পত্র-পত্রিকার পাতায় ও বিভিন্ন মাধ্যমে লেখালেখির মধ্য দিয়ে এবং বক্তৃতায় অনবরত আন্দোলনকারীদেরকে প্রেরণা যুগিয়েছেন। নজরুলের ভাষায়- আমি জানি জানি ঐ ভূয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তাও! তাই বিপ্লব আনি, বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তাও! তোর নিযুত নরকে ফুঁ দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুথু দি! আর যে যত রাগে রে তারে তত কাল্-আগুনের কাতুকুতু দি। তখন বুদ্ধিজীবীরাও তাদের আশার প্রতিফলনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেন এবং সব অগ্নিবীরকে উৎসাহিত করতে কণ্ঠে তুলে নেন নজরুলের বাণী- ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর! ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়।’
এই আন্দোলন পর্যালোচনা এবং গণঅভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ‘২৪’-এর গণঅভ্যুত্থানে আমাদের নজরুল ছিলেন চেতনার বাতিঘর। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে, ‘৪৭’-এর দেশভাগে, ‘৬৯’-এর গণঅভ্যুত্থানে এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও নজরুল একইভাবে প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য ছিলেন।
এক সময় নজরুলের লেখাকে স্থানিক ও ক্ষণস্থায়ী বলে অবজ্ঞা করেছিলেন কেউ কেউ। ইংরেজ কবি ও সাংবাদিক রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের সাথে তুলনা করে তারা নজরুলের লেখাকে ‘সাময়িক কোলাহলপূর্ণ’ বলে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারা বুঝতে পারেননি যে, নজরুলের লেখা হয়ে উঠবে সারা জীবনের জন্য ‘সাময়িক’। অর্থাৎ ১০০ বছর পরে এসেও নজরুল আজকে যেমন সদ্য ও সাময়িক, তেমনি আজ থেকে হাজার হাজার বছর পরেও যদি কোন নিপীড়িত মানুষ তাঁর কবিতা পড়ে, কোন প্রতিবাদী মানুষ যদি শোনে তাঁর গান, মনে হবে -এ লেখা বোধ হয় আমাদের জন্যই লেখা। এখনই লেখা। এ থেকে বুঝা যায়, সাময়িকতাকে ছাপিয়ে শাশ্বত হয়ে বেঁচে আছে নজরুলের লেখা। নজরুল যে শাশ্বত লেখক হওয়ার মন্ত্র জানতেন- সে কথা আবারও প্রমাণিত হলো বাংলাদেশের ‘২৪’-এর গণঅভ্যুত্থানে নজরুলীয় চেতনার স্ফুরণ এবং বিপ্লবীদের কাছে নজরুলের চেতনা-সারথি হওয়ার ইতিহাস দেখে।
ইতিহাস স্বীকৃত যুগান্তকারী এ আন্দোলন ও অভ্যুত্থান বাঙালি জাতির প্রেরণা হয়ে আগামী দিনের স্বপ্ন বুনবে। বিজয়ী আন্দোলন, বিজয় ও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী আগস্টের দেয়ালচিত্র, গ্রাফিতী চিত্র শিল্পীর তুলিতে যেভাবে নজরুল জায়গা করে নিয়েছেন, তার সৃষ্টি গান ও কবিতায় তা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের অন্য কোন কবির উদাহরণে পাওয়া যায় কিনা ভেবে দেখবেন।
‘২৪’-এর গণঅভ্যুত্থান আমাদের নজরুল’ কোন পক্ষের নয় শুধু বাংলা পক্ষের অর্থাৎ আমাদের-ই রয়ে গেল। নজরুলময় এ বাংলাদেশে সব স্বপ্নের সম্ভাবনাকে সফল করতে একতাবদ্ধ হতে চাই। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী জাতীয় পর্যায়ের ৭ দিনব্যাপী পালনের দাবি সাধারণ জনগণের। শাহবাগ চত্বরে ছাত্রজনতার আয়োজনে দিনব্যাপী নজরুল স্মরণোৎসব দেখতে চাই। সব বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ব্যাপকভাবে নজরুল উৎসব পালন করা হোক। আমরা কবির স্মরণোৎসব জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে দেখতে চাই। আমাদের এ প্রাণের দাবি মেনে নেওয়া হবে- এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।