শেখ সাইফুল ইসলাম কবির
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো জনগণের মতামতের প্রতিফলন। জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এই মতামত প্রতিফলিত হয়। তাই একটি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য নির্ভর করে তার নির্বাচনী পদ্ধতির উপর। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত দুটি প্রধান নির্বাচনী পদ্ধতির একটি হলো "প্রথমে আসা, প্রথমে জয় (FPTP)" এবং অন্যটি "আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি (Proportional Representation বা PR)।" এই প্রবন্ধে আলোচিত হবে, পি.আর. পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কীভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
---
পি.আর. পদ্ধতি কী?
পি.আর. পদ্ধতি এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা, যেখানে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী যে পরিমাণ ভোট পায়, সে অনুযায়ী সংসদে তাদের আসন বরাদ্দ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো দল যদি মোট ভোটের ৩০% পায়, তাহলে তারা মোট আসনের প্রায় ৩০% পাবে। এই পদ্ধতিতে সাধারণত দেশকে বড় বড় নির্বাচনী অঞ্চলে ভাগ করে একাধিক প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়।
---
জনগণের প্রত্যাশা কী?
একজন সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিকোণ থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের কিছু মৌলিক প্রত্যাশা থাকে:
তাদের মতামতের প্রতিফলন
সংখ্যালঘুদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব
ন্যায্য ও স্বচ্ছ নির্বাচন
দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক সরকার
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন
---
পি.আর. পদ্ধতি জনগণের প্রত্যাশা পূরণে যেসব ভূমিকা রাখতে পারে
১. সব ভোটের মূল্যায়ন নিশ্চিত করে
পি.আর. পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোট গুরুত্বপূর্ণ। FPTP পদ্ধতিতে অনেক সময় প্রার্থী সামান্য ব্যবধানে জিতে গেলেও পরাজিত প্রার্থীর পক্ষে পড়া বিপুল ভোট হিসেবেই আসে না। কিন্তু পি.আর. পদ্ধতিতে সেই ভোটগুলোও দলীয়ভাবে গণনায় অংশ নেয়, ফলে জনগণ মনে করে তাদের ভোট "নষ্ট" হয়নি।
২. সংখ্যালঘু ও ছোট দলগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করে
এই পদ্ধতিতে বড় দলগুলোর পাশাপাশি ছোট দল ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোরও প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার সুযোগ থাকে। ফলে জনগণের মতের বৈচিত্র্য সংসদে প্রতিফলিত হয়, যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. জনগণের মতামতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে
পি.আর. পদ্ধতিতে নির্বাচনী ফলাফল সরাসরি ভোটের অনুপাতে ঘটে। এর ফলে জনমত যেমন রয়েছে, সংসদেও তার প্রতিফলন তেমনি থাকে। এতে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং তারা মনে করে যে সরকার সত্যিকার অর্থেই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে।
৪. দলীয় দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা বাড়ে
যেহেতু প্রতিটি ভোট আসনে রূপান্তরিত হয়, তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেতন থাকতে হয় যেন তারা জনগণের আস্থা অর্জন করে। এতে নীতিনির্ভর রাজনীতি, উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা এবং সুশাসনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
৫. সহনশীল ও আপসহীন রাজনীতির পরিবর্তে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি গড়ে ওঠে
পি.আর. পদ্ধতিতে এককভাবে সরকার গঠন কঠিন, ফলে দলগুলোকে একত্রে জোট গঠন করতে হয়। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক পরিপক্বতা বৃদ্ধি করে।
---
সীমাবদ্ধতাও রয়েছে
তবে পি.আর. পদ্ধতির কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
অনেক সময় সরকার গঠন জটিল ও সময়সাপেক্ষ হয়
অতি ছোট দলগুলোর প্রভাব সরকারকে দুর্বল করতে পারে
জোট সরকারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হতে পারে
ভোটারের সঙ্গে প্রার্থীর সরাসরি যোগাযোগ কমে যেতে পারে
তবে এসব সীমাবদ্ধতা থাকলেও, সেগুলো দূর করার মতো কাঠামোগত ও নীতিগত সমাধান সম্ভব।
---
উপসংহার
সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, পি.আর. পদ্ধতি জনগণের প্রত্যাশা পূরণের একটি কার্যকর মাধ্যম। এটি শুধু নির্বাচনকে ন্যায্য করে না, বরং সমাজের বিভিন্ন মত ও শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষা করে। যদি সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা যায়, তবে পি.আর. পদ্ধতি ভবিষ্যতের জন্য একটি জনবান্ধব, অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচনী পদ্ধতি হতে পারে।
শেখ সাইফুল ইসলাম কবির
চেয়ারম্যান জাতীয় মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম কেন্দ্রিয় কমিটি ঢাকা।
গণমাধ্যম কর্মী -কলামিস্ট।