এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী
বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৫ আগস্ট ৭ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। কক্সবাজারের উখিয়ার ইনানীতে অবস্থিত হোটেল বে ওয়াচে ২৪-২৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত ‘টেক অ্যাওয়ে টু দ্যা হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ শীর্ষক তিন দিনের সম্মেলনে তিনি প্রস্তাবগুলো দেন। সম্মেলনে যোগ দেন ৪০টি দেশের প্রতিনিধি। ছিলেন জাতিসংঘসহ রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করা সব অংশীজন। অথচ এই সম্মেলনে স্থানীয় রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়ার তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগী সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের তেমন আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সম্মেলনের শেষ দিনে ২৬ আগস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন বিদেশি অতিথিরা। তিন দিনের সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ছাড়াও আন্তর্জাতিক ফান্ড, গণহত্যার বিচার, খাদ্য সহায়তা ও রোহিঙ্গাদের মনোবল বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়। এছাড়াও সম্মেলন থেকে আসা প্রস্তাব এবং বক্তব্যগুলো আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের সম্মেলনে তুলে ধরবে সরকার।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কক্সবাজারবাসীর একটি মাত্র দফা, সেটা হচ্ছে বিনাশর্তে সব রোহিঙ্গার নিজ মাতৃভিটায় প্রত্যাবাসন করা। তা না হলে রোহিঙ্গাদের বোঝা শুধু কক্সবাজারবাসীদের কাঁধে না ঝুলিয়ে বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় আনুপাতিক হারে পুনঃবাসন করা কিংবা জাতিসংঘের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে আনুপাতিক হারে অভিবাসন করা। এই এক দফা ব্যতীত কোন দফা আমরা বুঝতে চাই না।। যার জ্বালা সেই বুঝে। কক্সবাজারবাসী বুঝে রোহিঙ্গা আপদের বিষ-জ্বালা।
আমাদের দাবি, রোহিঙ্গাদেরকে শুধু উখিয়া ও টেকনাফে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় সংখ্যাঅনুপাতে ভাগ করে দেওয়া হোক। বাংলাদেশের সীমান্তে ১ কিলোমিটারের মধ্যে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা রাখাতে যে কোন মুহুর্তে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। দেশের বৃহৎ স্বার্থে রোহিঙ্গাদেরকে এক যায়গায় না রেখে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছিটিয়ে দিলে রোহিঙ্গা অপরাধ কমানো সম্ভব হবে। তা না হলে রোহিঙ্গারা একত্রিত হয়ে যে কোন সময় যে কোন মুহুর্তে দেশের বড় ধরনের ক্ষতিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটানোর সম্ভাবনা আছে। তবে রোহিঙ্গাদেরকে ভাসান চরের মত সম্ভাবনাময় যায়গায় না নেওয়া উত্তম।
খুবই পরিতাপের বিষয় স্থানীয়দেরকে কোন ধরনের এনজিওর চাকরিতে নিয়োগ দিচ্ছে না। যারা এনজিওতে ৮ বছর ধরে কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করেছে, তাদেরকে ছাঁটাই করে বহিরাগতদেরকে নিয়োগ দিচ্ছে। সেই বহিরাগতরা রোহিঙ্গা প্রীতির কারণে এনজিওর চাকরিজীবীরা সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় রোহিঙ্গাদেরকে এনআইডি করে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ জানে, এ ধরনের কত রোহিঙ্গা এনআইডি করে বিদেশ গিয়ে আমাদের সম্মান হানি করছে। হয়তো দুইজন ধরা পড়েছে আরো কত যে এনআইডি করেছে তার কোন হিসাব আছে?
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপুল জনসংখ্যার চাপে আশ্রয়দাতা বাংলাদেশও রয়েছে বিপদে। রোহিঙ্গাদের কারণে পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে; সামাজিক অসন্তোষ বাড়ছে; রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও এর আশপাশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটছে। বিশেষত, মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচারের মতো ভয়ংকর সমস্যাগুলোর বিস্তার ঘটছে। যতই দিন যাবে, এসব সমস্যা ততই জটিল হবে এবং বৃদ্ধি পাবে। এ কারণেই রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান ও তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এ জন্য প্রয়োজন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে মরীচিকা বা কল্পকথার বদলে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের আওতায় এনে সফল করার চেষ্টা চালানো।
এদিকে আরেকটি গোষ্ঠী মিয়ানমারে চলমান সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। কিন্তু বিতাড়িত রোহিঙ্গারা এ আন্দোলন বা সশস্ত্র লড়াইয়ে অনুপস্থিত। কখনো তাদের কিছু অংশ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কিংবা আরাকান আর্মির পক্ষে লড়াই করেছে। কোনো কোনো গ্রুপ চাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের নিজস্ব বাহিনী তৈরি করে সশস্ত্র পথে আরাকানের মাটি ফিরে পেতে। তারা স্লোগান দিয়েছে, ‘ভিক্ষা চাই না, মাটি চাই।’ এ প্রচেষ্টার সঙ্গেও দেশি-বিদেশি রোহিঙ্গা নেতারা সংশ্লিষ্ট রয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের প্রয়োজন নিজেদের অধিকার নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া, বাংলাদেশের প্রয়োজন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ও অন্যান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি টেকসই প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে নানা রকমের নতুন সমস্যা ও ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেসব সমস্যা বাংলাদেশকেই এককভাবে সামাল দিতে হবে। রোহিঙ্গাদের কারণে বর্তমানে যে মানবিক, আর্থিক, সামাজিক বা পরিবেশগত সমস্যা চলছে, সামনের দিনগুলোতে এর সঙ্গে যদি রাজনৈতিক ও সামরিক সমস্যা যুক্ত হয়, তা বাংলাদেশের জন্য বিরাট বিপদ তৈরি করবে। পাশেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অস্থির এবং নানাবিধ সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কারণে নাজুক। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ঘিরে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সমস্যার সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হবে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
অতএব, রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি কেবল মানবিক ত্রাণ সহায়তার পরিসরে দেখার অবকাশ কম। দূরদৃষ্টিতে নিয়ে দেখলে বুঝা যায়, এ সমস্যার দীর্ঘসূত্রতা ও বিস্তারের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি ও বিভিন্ন মাত্রার চ্যালেঞ্জও অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। কাজেই প্রত্যাবাসন কেবল রোহিঙ্গাদের জন্যই নয়, বাংলাদেশের জন্যও স্বস্তিদায়ক বিষয়।
লেখক: মহাসচিব, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম জাতীয় কমিটি, চেয়ারম্যান, পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ, উখিয়া, কক্সবাজার।