লেখকঃ ইঞ্জিঃ মোঃ সিরাজুল ইসলাম
আমার বাবা দাদা ছিলেন ভারতীয়, আমার জন্ম পাকিস্তান! আমি অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত উর্দু পড়েছি! আমার মাতৃভাষা ছিলো বাংলা! আমি দৈব চক্রে বাংলাদেশের চাকুরী ফেলে মধ্য প্রাচ্যের একটা দেশে গেলাম! চাকরি নিয়ে চলে গেলাম “মক্কা”। কোম্পানি আবাস স্হল দিলেন ” মীণায়”! এক ইঞ্জিনিয়ারের দুই রুম ফ্রী ফার্নিশ কোয়ার্টার! আমার সাথে কোন বাঙালি চাকুরী করতো না, অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ার মিশরী, পাকিস্তানি, ভারতীয় অল্প দু’একজন, টেকনিশিয়ান সবই প্রায় সুদান ও মিশরীয় ! আমি বেশ বিব্রত বোধ করতাম যখন আমার পাকিস্তানের ইঞ্জিনিয়ার ভাইরা এসেই উর্দু তে কথা বলা শুরু করতেন! আমি যখন তাকে বলতাম, sorry I am from Bangladesh, তিনি উল্টো আমাকে প্রশ্ন করতেন, আপকো উর্দু নেহি আতা হ্যায়! যখন বলতাম no, তিনি উত্তর দিতেন, কিউ নেহি আতা হ্যায়, আনা চাহিয়ে! মনে হতো উর্দু একটা আন্তর্জাতিক ভাষা যা জানি না বলে মহা অপরাধ করে ফেলেছি! অবশ্য বাংলাদেশের মত পাকিস্তান ও একটা ভুল করেছে, সব কিছু মাতৃভাষায় করতে হবে বলে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ একদম শুধু উর্দু তে পাঠ দান করেছে, তার মধ্যে করাচি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় একটা যেখান থেকে আগতরা চায়নাদের মত নিজ ভাষা ছাড়া ইংরেজি শেখে নাই! তাছাড়া তাদের “মধ্য প্রাচে” চাকুরী করা কোন অসুবিধা ছিলো না, দ্রুত আরবি শিখে ফেলতো কারন উর্দু কোন আলাদা ভাষা না, আরবির একটু সংস্করণ মাত্র।
প্রিয় পাঠক, পাকিস্তান জন্মগ্রহণ বৃত্তান্ত অনেক জটিল না, বেশ সাইক্লোজিক্যাল বিভ্রান্তি আছে!
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র যারা চাইলেন তারা কেউ পাকিস্তান অংশের লোক না! জাতির জনক মুহম্মদ আলী জিন্নাহ জন্মসূত্রে গুজরাটি, তিনি গুজরাটি ও উর্দু ভাষায় সাবলীল ছিলেন না! তুখোড় ছিলেন ইংরেজিতে! মনে হতো “ইংরেজি” তার Mother tongue! গুজরাটের ভাষাও উর্দু না, গুজরাটি!
জিন্নাহর ইন্তেকালের পর “লিয়াকত আলী খান” প্রধানমন্ত্রী হোন, তিনি ছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশে যেখানকার মাতৃভাষা ছিলো উর্দু! এই দু’জন নেতার চেষ্টায় পাকিস্তান নামক দেশ তৈরি হয়! সেখানে দাদা ভাই, প্যাটেল, নেহেরু, গান্ধী, লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন, তার সহধর্মিণীর গুটিচালা গল্পে আমি যাবো না! তবে ভালো মুসলমান যারা মাওলানা আজাদ, মওলানা মওদুদী, সীমান্ত গান্ধী খান গফ্ফার খান, কেউ ই পাকিস্তান চান নাই! জামাতে ইসলামের প্রতিষ্ঠা মাওলানা মওদুদী আর এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, “সব হিন্দু ভারতে রেখে পাকিস্তানে যেয়ে কাকে ইসলাম ধর্ম শিখাবো?” ভারতে তো আমাদের চেয়ে বেশী মুসলমান রেখে গেলাম!”
১৯৫২ সালে জাতির জনক জিন্নাহর “Urdu and Urdu should be the state langue” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের ভাষন বাংলাদেশ নামক দেশের বীজ রোপন হয়ে গিয়েছিলো “জনকের” অজান্তেই! কোন দেশের সরকার সে দেশের সাধারণ জনগণ কে ক্ষেপিয়ে তোলার মত পদক্ষেপে যাওয়া উচিত না! “জনক” সে কাজটা করলেন অরাজনৈতিক ব্যক্তির মত!
কেন উর্দু রাষ্ট্র ভাষা করতে হলো এবং উর্দুর উপর অনড় থেকে পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণের বসবাস অঞ্চল হাতছাড়া করে দিতে হলো?
পাঠক, পাকিস্তানের মাত্র ৪% লোক তখন উর্দু তে কথা বলতো। বাংলায় কথা বলতো ৫৬% মানুষ। বাংলা উর্দু দুটোকে রাষ্ট্র ভাষা করা যেতো। ভারতে তো কোন জাতীয় ভাষা নাই যেহেতু ৪১৫ টা ভাষার লোক আছে ভারতে। তাদের অফিসিয়াল ভাষা হিন্দি ও ইংরেজি। ৪১৫ টা জীবিত ভাষা ছাড়াও কয়েকশো উপভাষা আছে। যেমন মুচি বাগদি ডোম মেথর সাওতাল শীল ব্যাধ বেদে সাপুড়ে মুদ্দা বুরমো বাহারি ইত্যাদি দের ভাষা যার যার, রাষ্ট্র বুঝলো কিনা তা নিয়ে মাথা ব্যথা নাই! ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের ৫ কোটি লোক উর্দু তে কথা বলে, প্রায় ৪% মানুষ উর্দু বলে ভারতে, পাকিস্তান বরাবর! সেখানে উর্দু নিয়ে মাথা ব্যথা নাই!
ততকালীন পাকিস্তানে পাঁচটা প্রদেশ ছিলো। কোন প্রদেশের ভাষা উর্দু নয়। বাংলাদেশের ভাষা বাংলা, পাঞ্জাবের ভাষা পাঞ্জাবি, বেলুচিস্তানের ভাষা বেলুচ, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ভাষা পশতু! এবং সবার নিজ নিজ ভাষায় সমৃদ্ধ সংস্কৃতি কৃষ্টি কালচার সাহিত্য কবিতা সিনেমা গান আছে! আমি অনেক পাঞ্জাবি সিনেমা ও নাটক দেখেছি! তা হলে শুধু লিয়াকত আলী খানের উর্দু দাড় করাতে বাংলাদেশের মত বৃহৎ ভূখন্ড হারানোর বোকামি ছাড়া আর কিছু না!
আমরা হারালাম আমাদের জন্মস্থান, পাকিস্তান হারালো তার সুজলা সুফলা আয়ের প্রধান ভূখন্ড টা! তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ বেলুচিস্তানের অবস্থা ও অনেকটা বাংলাদেশের মত, তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করছে বেশ আগে, B L A মুক্তি যোদ্ধা গঠিত হয়ে লড়াই চালাচ্ছে! বাংলাদেশের মত বেলুচিস্তান পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহৎ ভুখন্ড যেখানে পাকিস্তানের মোট ভূখন্ডের ৪০% বেলুচিস্তান। সেখানেও দমন পীড়নে বশে আনা আইডিওলজি!
এখন চীন বা ভারত কেউ বেলুচদের অর্থ অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলে বাংলাদেশের মত অবস্থা হবে বেলুচিস্তানের।
তাইতো মোহন লাল বলেছিলেন, নবাব সিরাজুদ্দৌলার কূটনীতিক অপরিপক্কতা দেখে যখন তিনি জগৎশেঠের গলার মুক্তার মালা ক্রোধে নিজ হাতে ছিড়ে ফেলেছিলেন, বলেছিলেন মোহন লাল “রাজাকে রাজনীতি জানতে হয়!” আমি নিজে ও প্রবন্ধে এই মোহন লালের বাক্য প্রয়োগ করেছিলাম যখন শেখ হাসিনা কোটা আন্দোলন আলোচনায় মিমাংসা না করে HOSTILE পথ বেছে নিয়েছিলেন! আজ ও বলবো,”আমাদের জাতির জনক জিন্নাহ ৫৬% বাঙালির ভাষাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষা মেনে নিলে ও আমরা পাকিস্তানের সাথে আজও অখন্ড পাকিস্তানে বাস করতে পারতাম! যদিও ৮ টা মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি পশ্চিম পাকিস্তানে হওয়ার পর একটা ফ্যাক্টরি গাজীপুর দিয়েছিলেন পাক প্রশাসন, কর্নেলের উপরে বাঙালি প্রমোশন ছিলো না সেনাবাহিনী তে, বিদ্যুৎ বৈষম্য ছিলো ১০:১ এমন বৈষম্য মুজিব জনগনকে বুঝাতে পারতো না যত সহজে বুঝেছে জনগন “তাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চায়!”
পাকিস্তান শাসকরা আজও মোহন লালের বাক্যের যোগ্য হতে পারে নাই, তা হলে বাংলাদেশের মত বেলুচিস্তানের জনগনের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হতোই না!
ভালো থাকেন সুস্থ থাকেন নিজ দেশেকে ভালোবাসেন!