আলহাজ্ব মো. আব্দুল আজিজ
৫৫তম আন্তর্জাতিক ও ঐতিহাসিক চুনতি সীরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলের শুভ উদ্বোধন আজ ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বৃহস্পতিবার। ১৯ দিনব্যাপী সীরাতুন্নবী মাহফিলের গুরুত্ব হলো, এটি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ও আদর্শকে কেন্দ্র করে একটি ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যা মুসলমানদের ইসলামের মূল শিক্ষা ও রাসূল (সা.)-এর প্রদর্শিত পথে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। এই মাহফিল মুসলিম সমাজে অধঃপতন ও বিচ্যুতি রোধ করে, আল-কুরআনের শিক্ষা ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং একটি বৃহত্তর মিলনমেলা তৈরি করে, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের আপ্যায়নেরও সুব্যবস্থা থাকে।
বরাবরের ন্যায় এবারও এই মাহফিল ১১ই রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২৯ রবিউল আউয়াল ২২শে সেপ্টেম্বর সোমবার দিবাগত রাত শেষে ভোরে আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হবে।
চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানার অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আধ্যাত্মিক পুরুষ অলিকূল শিরোমণি, আশেকে রসূল (সা.) প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ শাহ ছাহেব কেবলা চুনতী কর্তৃক প্রবর্তিত হয়।
এই মাহফিলের মূল উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের ইসলাম ও সুন্নাহর মূল নীতি ও শিক্ষা থেকে বিচ্যুতি রোধ করে পুনরায় সেদিকে ফিরিয়ে আনা। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট বিষয়ে সম্মানিত ওয়ায়েজগণ বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেন, যা মুসলমানদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে। এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী বিশাল ধর্মীয় মিলনমেলা, যেখানে লক্ষাধিক মানুষের খাওয়াদাওয়া ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
সুশৃঙ্খল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও অনন্য ধর্মীয় মাহফিল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এই মাহফিল মুসলমানদের সমাজে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সামাজিক কল্যাণের বার্তা নিয়ে আসে। ঐতিহাসিক ১৯ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সীরাতুন্নাবী মাহফিলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা। নির্দিষ্ট বিষয়ে গভীর প্রস্তুতি ও গবেষণা নিয়ে সম্মানিত ওয়ায়েজ গন এখানে বয়ান করে থাকেন।
১৯৭২ সাল থেকে এই পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে আসা এই মাহফিল কুরআনের চলমান মুজিযার একটি অংশ ও জীবন্ত কারামত। আবহমানকাল থেকে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগামী চুনতীর ইতিহাস ও এতিহ্য ইসলাম প্রচারের ইতিহাসেও সমৃদ্ধ। জানা যায়, বৃটিশ ভারতে বাংলা অঞ্চলে যখন শিক্ষার হার শতকরা ২০, তখন চুনতী অঞ্চলে শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ। ১৮৩১ সালে ভারত পাকিস্তানের সীমান্তে সংঘটিত বালাকোটের জিহাদে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী রহ. এর ডাকে সাড়া দিয়ে চুনতীর মর্দে মুজাহিদ হযরত মাওলানা আবদুল হাকিমসহ (গাজীয়ে বালাকোট রহ.) আমিরাবাদ এলাকার মাওলানা সৈয়দ ওয়ারেস আলী (শহীদে বালাকোট রহ.) লোহাগাড়া এলাকাকে ইসলামের জন্য উর্বর ভূমিতে পরিণত করেছেন।
চুনতী এলাকায় অনেক মাকবুল আল্লাহর বান্দা, অলী, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, সমাজ সেবক, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের জন্ম। এই অঞ্চলের আবেদগণ আল্লাহর দরবারে চুনতীকে একটি মকবুল স্থান হিসেবে কবুল করাতে সক্ষম হয়েছেন। পূর্বপ্রস্তুতিসহ টানা ১৯ দিন ব্যাপী সীরাতুন্নবী সা. মাহফিলের চতুর্মাত্রিক আয়োজন শুধুমাত্র টাকা আর শ্রম দিয়ে সম্ভব নয়। এই মাহফিলের উপর রয়েছে আল্লাহর বিশেষ রহমত ও মদীনা মুনাওয়ারা থেকে রাসূল সা. এর বিশেষ সুনজর।
হযরত শাহ সাহেব রহ. বলেছেন, চুনতী খাঁর দিঘীর মসজিদ (বর্তমান মিডওয়ে হোটেলের দক্ষিণে চট্ট-কক্স রোডের পশ্চিম পাশে) এলাকায় রাসূল (সা.) এর দু’জন সাহাবীর কবর রয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, চারজন সাহাবী (রা.) চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করেছেন। তাঁদের অন্য দু’জনের কবর বর্তমান চীনের ক্যান্টন অঞ্চলে রয়েছে।
মাহফিলকে অর্থবহ ও আলোচনা ফলপ্রসূ করার জন্য একদল দক্ষ আলেম ও গবেষক প্রতি বছর আমন্ত্রিত আলোচকগণের বিষয়বস্তু নির্ধারণে নিরলসভাবে কাজ করেন। মাহফিলের একেকটা আলোচনার বিষয় যেন এম ফিল ও পিএইচডি করার উপযোগী টপিক, যা ইতোমধ্যে দেশের শিক্ষিত ও গবেষকমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। চুনতী হাকিমিয়া আলীয়া মাদরাসার শিক্ষকমণ্ডলী ও দেশের বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত চুনতীর সাবেক শিক্ষার্থীগণ এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এরকম সুশৃংখল বিষয়ভিত্তিক আলোচনার ধারাবাহিক মাহফিল ইতিহাসে বিরল। চুনতী মাদরাসার সাবেক নাজেমে আলা আল্লামা ফজলুল্লাহ রহ. বিষয় অনুযায়ী আলোচনা পদ্ধতির মূল উদ্ভাবক।
খাবার তৈরি ও ব্যবস্থাপনা, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, জালানী জোগাড়, খাবার পরিবেশনা, আলেম, আলোচক, মেহমান ও দাতাদের যথাযথ আপ্যায়ন ও থাকার ব্যবস্থা, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, অজু ও ইবাদতের সুব্যবস্থা ইত্যাদি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। শতশত স্বেচ্ছাসেবক নিজের অর্থ, সময় ও শ্রম দিয়ে প্রতিনিয়ত নির্ধারিত জায়গায় নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন।
মাহফিলকে কেন্দ্র করে চুনতী ও আশেপাশের এলাকাগুলোতে উৎসবের আমেজ ও দ্বীনি আবহ সৃষ্টি হয়। আত্মীয়তার সম্পর্ক বা রেহেমকে পুনরুজ্জীবিত করার এক অনন্য মাধ্যম হলো সীরাত মাহফিল। নতুন পুরাতন, দূরের-কাছের আত্মীয় স্বজনের আগমণে মুখরিত হয় অত্র অঞ্চল। রেহেমের এই অটুট বন্ধনের কারণে পুরো চুনতীর উপর অঝোর ধারায় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়।
বিশেষভাবে বলতে চাই, হযরত রাসুল (দ.) এর চরিত্র ও আর্দশ হচ্ছে সর্বোত্তম আদর্শ। একজন মোমেন বান্দা হিসাবে রাসুল (দ.) এর জীবনাদর্শকে যথাযথ ভাবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে মেনে চলার দরকার। চুনতি সিরাত মাহফিল সেই প্রয়াশ চালিয়ে আসছে ৫৪ বছর যাবৎ।
এই মাহফিল নি:সন্দেহে আল্লাহর কাছে মকবুল মাহফিল। হযরত শাহ সাহেব (রহ.) নিজ যোগ্যতাবলে এই মাহফিলকে আল্লাহর দরবারে কবুলিয়তের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এই অঞ্চলে পদচারণা করলেই ইলম ও রূহানিয়তের অমীয় খুশবো পাওয়া যায়। দ্বীনি দুনিয়াবী শিক্ষার আবহে চুনতীর পাহাড়গুলোর চূড়ায় হেরার আলোর বিচ্যুরণ পরিলক্ষিত হয়। আল্লামা ইউসুফ রহ. এর বাগানের ‘শাহ মন্জিল’ হাজার বছরের চুনতীর ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে রাসূল সা. এর সীরাতকে আজ বিশ্ব দরবারে মিডিয়ার বদৌলতে ঘরে ঘরে পৌঁছানোর ব্যবস্থায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
৫৫ তম পবিত্র সিরাত মাহফিল এন্তেজামিয়া কমিটির এক প্রস্তুতি সভা মাহফিল মোতায়াল্লী কমিটির সভাপতি শাহজাদা মাওলানা হাফিজুল ইসলাম মু. আবুল কালাম আজাদ’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রস্তুতি সভায় উপস্থিত ছিলেন শাহজাদা মাওলানা আব্দুল মালেক ইবনে দিনার নাজাত ও অধ্যক্ষ মাওলানা হাফিজুল হক নিজামী, শাহজাদা তৈয়বুল হক বেদার প্রমূখ।
১৯ দিন ব্যাপী এ মাহফিলে এবারের বাজেট ৬ কোটি টাকা। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুদানের মাধ্যমে এ বাজেট পূরণ করা হয় প্রতিবছর। মাহফিল সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে উপ-কমিটি গঠন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মিটিং করেছেন এবং বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় মাহফিলের দাওয়াত দিয়েছেন বলে জানা যায়। পবিত্র ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী (সা.) লাইভ সম্প্রচারের মাধমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে কর্মরত সাংবাদিকদের সার্বিক সহযোগিতা জরুরী।
মহান আল্লাহ তাআলা ১৯ দিন ব্যাপী সীরাতুন্নবী সা. মাহফিলকে কিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ ৫৫ তম মাহফিল তাদের সকলের খেদমতকে আল্লাহ কবুল করুন আমিন।
লেখক: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এনভারনমেন্ট এন্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন, চেয়ারম্যান চ্যানেল কর্ণফুলী,।