
কলমেঃ কাকলি রানী ঘোষ
ইকির, বিকির, চাম চিকির, তিন ভাইবোন। ধরল ঠাকুমাকে গল্প বলে শোনাও দেখি। ঠাকুমা বলে নারে সময় কোথায় আমার। বয়স হয়েছে আমার। গল্প কি মনে থাকে আমার বলতো। ইকির, বিকির, চাম চিকির, ভারি নাছোড়বান্দা। ঠাকুমা বলতেই হবে তোমাকে ভুতের গল্প। ঠাকুমার কি করবে, বসে পড়লো গল্প নিয়ে।
বারান্দাতে চেয়ারটেবিলে বসে ডিম আলোই শুরু হলো গল্প।
ঠাকুরমা বললেন, ছোট আমি বয়স ৮ অথবা ১০ হবে। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম তরীতরকারি কিনতে হাটে। নৌকা ছিল ঘাটে। নদীতে ছিল অনেক জোয়ার ভাটা। বাবার সঙ্গে সমস্ত দিন ঘুরে ঘুরে বাজারেতে। হাটবাজারে বেচতে কিনতে অনেক দেরি হল। প্রায় রাত দশটা হবে। উঠলাম বাবা, আমি, নৌকাতে। সাথে আছে আরো কয়জন। ছোট আমি বুঝি নাকো, বসে আছি চুপটি করে। বাবার কাছে পাশাপাশি। ঘন অন্ধকার দেখা যায় না ভালো। নদীর পাশে বাড়িগুলোই আলো মিটমিট জলে। বিদ্যুৎ ছিল না কোন খানে। কাঁচা রাস্তা। যোগাযোগ ছিল নৌকার ব্যবস্থা। সাদা পাল তোলা নৌকা চলতো নদীর বুকে।
চিত্রপটে ছবি এঁকে উঠতো সোনার তরী বইছে নদীর পরে। সেদিন ছিল ভূত চতুর্দশী। ভুতু চতুর্দশীর মানে বোঝো। আমাবস্যার আগের দিন। ভূত প্রেতারা আসেন দলবেঁধে নিজো ভিটিতে। এটাই বিশ্বাস মানুষের। তাই প্রদীপ জ্বেলে রাখে সকলে। ভুতের যাতে ক্ষতি না করতে পারে।
চাম চিকির আগ্রহ নিয়ে বলল, ও থাক ঠাকুরমা, বল নৌকায় কি হলো।
ঠাকুমার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল। কি আর হবে যা অঘটন তাই ঘটলো।
বিকির বলল, একি অঘটন ঘটল বল,
ঠাকুরমা বলল এই চুপ, কথা বলতে দে আমায় দেখি।
সবাই একসঙ্গে বলল, এই হয়েছি চুপ, বল দেখি তাড়াতাড়ি।
নৌকা চলছে নদী দিয়ে। হালের শব্দ ঘ্যাস ঘ্যাস। চারিদিকে চুপচাপ। ছোট্ট হারিকেন জ্বলছে নৌকার উপর। মাঝে মাঝে শিয়াল ডাকছে হুক্কা হুয়া। কখনো ডাকে ঘুঘু পাখি। হুতুম পেঁচার ডাকছে গম্ভীর সুরে।
শিয়ালকাঁটায় ভরা নদীর পাড়। যাচ্ছে নৌকা ধীরে ধীরে। শ্মশান ঘাট ছিল নদীর পাড়ে। ভয়ে গা ছমছম করে। নৌকা এলো সেখানটাতে। কে যেন মরেছে সেই দিনে। শ্মশানেতে দাফন করে তারে।
বাবা বললেন ভয় পাচ্ছিস। আমি বললাম না বাবা ঠিকই তো আছি। ভয় পাচ্ছিলাম বেশ মনে মনে।
আমি যে সাহসী সেটা তো জানাতে হবে বাবাকে। গর্বের সঙ্গে বলেছিলাম না বাবা ভয় পায়না তো কোন। হঠাৎ দেখি শেয়াল যাচ্ছে দৌড়ে। শাক করে চলে গেল নৌকার সামনে দিয়ে কি যেন। বাবা বললেন ও বাদুড় ভয় পেয়ো না। আমি রইলাম চুপ করে। হঠাৎ সবাই বলে উঠলো, ও মাঝি ভাই দেখছো ওই যে কি আসছে ভেসে। ভেলার মত। একটু সাবধানেতে চলো। মাঝি বলল, এ তো দেখছি মরা মানুষের দেহ।
ইকির বলল, তারপর ঠাকুরমা, একসাথে সবাই বলে উঠল তারপর ঠাকুমা।
বাবা বললেন, তাকিও না ওদিকে, আমি মুখ ঢুকালাম বাবার হাঁটুর নিচে। মরা দেহটা ঠেকলো নৌকার পাশে। সবাই পেল ভয়। নামলাম এসে নদীর ঘাটে।
বাবার কোলে উঠে, বাড়ি যাওয়ার মুখে ছিল বাঁশের ঝাড়।। কচ কচ কচ করে ওঠে। রাতের মধ্যে জ্বর এলো গায়। মায়ের মুখে শোনা, জ্বরের ঘোরে ভুল বকে ছিলাম দুদিন তিনদিন। ওই দেখো না বাবা কে আসছে দেখি। সাদা কাপড় পড়া। নিয়ে গেল ভূতের রাজ্যে বুঝি। ধরোনা বাবা আমায়। হাঁটুর মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদি। আর যাওয়া হয়নি বাবার সঙ্গে আর বাজারে। বেশি রাত্রি হলে আমি যাইনা কোথাও। ভয়ে আমার এখনো দেয় গায়ে কাটা।
হঠাৎ ঠাকুরমা দেখলো চারিধারে নেই কেউ। গেল কোথায়! আশেপাশে খুঁজতে থাকে। ঠাকুমা বলল উচ্চস্বরে এই তোরা গেলি কোথায়। ইকির, বিকির, চাম চিকির ঢুকেছে টেবিলের তলে। ঠাকুমা বললেন চিৎকার করে। এখানে ঢুকেছিস কেন। সকলেই উত্তর দিল। ঠাকুমা ভূত এসেছিল আমাদের টেবিলে পরে ।
ঠাকুরমা বলল বলিস কিরে। আজ ভূত চতুর্দশী না, দাদু এসেছিল ওই টেবিলের কাছে।
ঠাকুমা বলল ধ্যাত বোকা, ওসব তোদের মনের ভুল। ভূত বলে কিছু নেইকো। যাদের যত ভয় তাদের তত ভূতে ধরে।