
লেখক: শহীদ বদরুদ্দোজা তৌহিদ
হিংস্র পশু হতে সাবধান থাকা যায়, কিন্তু হিংস্র মানুষ সব সময় চেনা যায় না”
মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব আশরাফুল মাখলুকাত। জ্ঞান, বিবেক, অনুভূতি ও বিচারবুদ্ধির দিক থেকে মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা। কিন্তু কখনো কখনো এই মানুষই হয়ে ওঠে সবচেয়ে ভয়ংকর, সবচেয়ে নির্মম—যাকে বলা যায় হিংস্র মানুষ। বনের হিংস্র জানোয়ার যেমন সিংহ, বাঘ, ভাল্লুক বা চিতা সহজেই চেনা যায়; তাদের দাঁত, নখর ও আচরণ থেকেই বোঝা যায় তারা বিপজ্জনক। কিন্তু মানুষের হিংস্রতা থাকে মুখোশের আড়ালে, যা বাইরে থেকে সহজে ধরা পড়ে না। এ কারণেই বলা হয়, “হিংস্র জানোয়ার হতে সাবধান থাকা যায়, কিন্তু হিংস্র মানুষ সব সময় চেনা যায় না।”
জানোয়ারের হিংস্রতা প্রকৃতিগত। তারা ক্ষুধা মেটাতে হত্যা করে, বাঁচার তাগিদে আক্রমণ করে। তাদের উদ্দেশ্য সোজা—খাদ্য ও নিরাপত্তা। কিন্তু মানুষের হিংস্রতা অনেক জটিল। কখনো তা আসে লোভ থেকে, কখনো অহংকার, প্রতিশোধ, বা ক্ষমতার লালসা থেকে। মানুষ মুখে হাসে, মিষ্টি কথা বলে, বন্ধুত্বের মুখোশ পরে, অথচ অন্তরে লুকিয়ে রাখে বিষের মতো ঘৃণা ও হিংসা। এই দ্বিচারিতা মানুষকে করে তোলে জানোয়ারের চেয়েও ভয়ংকর।
আজকের সমাজে এই হিংস্র মানুষদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তারা হয়তো নামকরা পেশাজীবী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ মানুষের ভিড়েই লুকিয়ে থাকে। তারা নিজের স্বার্থে অন্যকে ধ্বংস করতে দ্বিধা করে না। সমাজে প্রতারণা, অন্যায়, নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন, দুর্নীতি—সবই মানুষের হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ। অথচ এই মানুষগুলোকে বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না তাদের অন্তরের রূপ কতটা নোংরা।
হিংস্র মানুষ সব সময় চেনা যায় না কারণ তারা মুখোশধারী। তারা মিষ্টি কথায় মানুষকে ফাঁদে ফেলে, তারপর সুযোগ পেলে আঘাত করে। যেমন, প্রতারকরা ভালোবাসার অভিনয় করে মানুষকে ধ্বংস করে; ব্যবসার নাম করে লোক ঠকায়; রাজনীতির নামে মানুষের রক্ত ঝরায়। এইসব মানুষ বাহিরে সভ্য, ভদ্র, শিক্ষিত মনে হলেও তাদের হৃদয় নরকের মতো অন্ধকার।
জানোয়ারের আক্রমণ থেকে বাঁচতে আমরা দূরে থাকি, সতর্ক থাকি, নিরাপদ জায়গা খুঁজি। কিন্তু হিংস্র মানুষ থেকে বাঁচা অনেক কঠিন। কারণ, তারা সমাজের ভেতরেই থাকে—বন্ধুর ভেতর, আত্মীয়ের ভেতর, এমনকি পরিবারেও। তাদের হিংস্রতা দেখা যায় না চোখে, কিন্তু তা অনুভব করা যায় কষ্ট ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে।
তবে সব মানুষই হিংস্র নয়। এখনও পৃথিবীতে আছে মানবতা, মায়া, সহমর্মিতা। কিন্তু সমস্যা হলো—হিংস্র মানুষরা এত চতুরভাবে তাদের আসল মুখ লুকিয়ে রাখে যে, সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারে না। তাই আমাদের উচিত মানুষকে চিনতে শেখা, বিচার করতে শেখা, অন্ধ বিশ্বাস না করা। চোখে যা দেখি তা-ই সত্য নয়; আসল সত্য লুকিয়ে থাকে অন্তরে।
এই পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে হলে আমাদের মানবিক হতে হবে। হিংসা, প্রতিশোধ ও ঘৃণা নয়—ভালোবাসা, সহানুভূতি ও ন্যায়ের পথে চলতে হবে। হিংস্র মানুষকে চিনে তাদের প্রভাব থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। কারণ, একবার তারা কাছাকাছি এলে আমাদের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে।
সবশেষে বলা যায়, জানোয়ারের হিংস্রতা প্রকৃতির নিয়ম, কিন্তু মানুষের হিংস্রতা সমাজের অভিশাপ। জানোয়ারকে বন্দী করা যায়, কিন্তু হিংস্র মানুষকে চেনা যায় না যতক্ষণ না সে তার মুখোশ খুলে ফেলে। তাই সত্যিই সত্যিই—
“হিংস্র জানোয়ার হতে সাবধান থাকা যায়, কিন্তু হিংস্র মানুষ সব সময় চেনা যায় না।”