হুমায়ুন কবির জুশান, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে:
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সারা দেশে যেমন রাজনৈতিক অঙ্গন গরম হয়ে উঠেছে, তেমনি কক্সবাজার-৪ (উখিয়া–টেকনাফ) আসনেও শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান, পালংখালী ইউনিয়নের জনপ্রিয় জননেতা এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী।
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, নির্লোভ ব্যক্তিত্ব ও নির্ভীক নেতৃত্বের কারণে তিনি এখন এই উপকূলীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে এক নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করেছেন।
অতীতের ইতিহাস, বর্তমানের সম্ভাবনা
স্বাধীনতার পর থেকে উখিয়া–টেকনাফ আসন জাতীয় রাজনীতিতে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভোটার এবং ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে এই আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বেশি থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে জননির্ভর নেতৃত্বের ভূমিকা সবসময়ই নির্ধারক ছিল।এই প্রেক্ষাপটেই পালংখালীর চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরীর স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় সৃষ্টি হয়েছে তুমুল উত্তেজনা।
জনপ্রিয়তার মূলে জনগণের ভালোবাসা গফুর উদ্দিন চৌধুরী পালংখালী ইউনিয়নের মুসলিম সাম্রাজ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম সুলতান আহমদ চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৮ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপির প্রথম ইউনিয়ন সভাপতি। পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় গফুর উদ্দিনও রাজনীতিতে যুক্ত হন।
আওয়ামী লীগের বেশ কিছু প্রভাবশালী নেতা নীরবে তাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে নামার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন,সবাই দলীয়ভাবে নির্বাচন করলে জনগণের আসল কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। আমি দলের জন্য নয়, জনগণের জন্য রাজনীতি করি। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে, তাদের সেবা অব্যাহত রাখতে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছি
তিনি বলেন,দলীয় রাজনীতির চেয়ে জনগণের রাজনীতি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।
বিএনপি-জামায়াতের শক্ত অবস্থানের মধ্যে জয়ের সম্ভাবনা কতটা?—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা কী করেছে তা সবাই জানে। আমি পর্যন্ত তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাইনি। আমাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ঢাকায় আটক করে জেলে পাঠানো হয়েছিল। সেই কষ্ট আজও ভুলতে পারিনি। তাই তাদের সঙ্গে এক মঞ্চে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
বিএনপির প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীর প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেন, “শাহজাহান চৌধুরী নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে সম্মান করি। তবে সুযোগ পেলে আমি জানতে চাইবো—আমার অপরাধ কী ছিল? কেন আমাকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হলো? কেন জেলে পাঠানো হলো?
তিনি আরও বলেন, শাহজাহান চৌধুরী এবার প্রবল সম্ভাবনাময় প্রার্থী ছিলেন, কিন্তু তার পরিবারের কিছু কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়।
আওয়ামী লীগের নেতারা শেষ সময়ে শাহজাহান চৌধুরীর পক্ষে চলে যেতে পারেন—এমন আশঙ্কা নিয়ে গফুর উদ্দিন চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “আমি কবর পর্যন্ত তাদের দলে যাবো না। এখন আমি নিজেই প্রার্থী, অন্য দলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
শেষে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ কখনও বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দেবে না। তাই এই আসনে যদি আমি লড়ি, জয়ের সম্ভাবনা আমারই বেশি। জনগণই আমার আসল শক্তি।
১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালে ইউপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও জয় না পেলেও, ২০১১ সালে প্রথমবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েন। এরপর ২০১৬ ও ২০২১ সালে টানা তিনবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে টানা ১৫ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন—যা পালংখালীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।
নির্যাতন, মামলা ও দৃঢ়তার গল্প
চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হয়েছেন বহুবার। ২০১৩ সালে মাইক ও গাড়ি পোড়ানোর মামলাসহ একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হন। ২০১৮ সালে দ্রুত বিচার আইনে আরও ১৯টি মামলায় নাম আসে তাঁর।
তাঁকে চারবার সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই হাইকোর্টের আদেশে পুনর্বহাল হন।
গফুর উদ্দিন বলেন,মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র—কিছুই আমাকে জনগণের সেবা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আমি মানুষের ভালোবাসার শক্তিতেই দাঁড়িয়ে আছি।
সম্প্রতি তিনি ঘোষণা দিয়েছেন—আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়বেন।
তিনি বলেন,সবাই দলীয়ভাবে নির্বাচন করলে জনগণের আসল কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। আমি দলের জন্য নয়, জনগণের জন্য রাজনীতি করি। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, দলের অনেক তৃণমূল নেতা নীরবে তাঁর প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত এবং বিএনপি–জামায়াত জোটের ঘাঁটি শক্ত থাকায়, তাঁর প্রার্থিতা নির্বাচনের মাঠে নতুন কৌশল ও সমীকরণ তৈরি করবে।
জনআস্থার কারণ,উন্নয়ন ও মানবসেবা
গফুর উদ্দিন চৌধুরীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যেই পালংখালীর মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণে তিনি দৃশ্যমান পরিবর্তন এনেছেন। শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান ও জমি দান তাঁর পরিবারের ঐতিহ্য।মাদক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন তিনি। তাঁর প্রতিশ্রুতি সীমান্তে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মাদক প্রতিরোধ ব্যবস্থা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুততর করা,প্রতিটি ইউনিয়নে আধুনিক কমিউনিটি ক্লিনিক ও মাতৃস্বাস্থ্য সেবা,আইটি ট্রেনিং সেন্টার, টেকনিক্যাল স্কুল ও কর্মসংস্থান প্রকল্প,নারীর উদ্যোক্তা সহায়তা ও সুরক্ষা নেটওয়ার্ক,
টেকনাফ–সেন্টমার্টিনকে পরিবেশবান্ধব আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।
ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও নতুন উত্তেজনা
উখিয়া–টেকনাফে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধরা হচ্ছিল বিএনপির শাহজাহান চৌধুরী ও জামায়াতের নুর আহমদ আনোয়ারীর মধ্যে। কিন্তু গফুর উদ্দিনের স্বতন্ত্র প্রার্থীতা আসনটিকে এখন “ত্রিমুখী যুদ্ধক্ষেত্র”-এ পরিণত করেছে।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশের ভোট তাঁর দিকে ঝুঁকছে। ফলে ভোটের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত হতে পারবে না কে এগিয়ে আছেন।
ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক অবদান
১৯৬৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী জান্নাতারা বেগম। তাঁদের চার সন্তান—নাসরিন সুলতানা কলি, হুমায়রা সুলতানা শিউলি, এম. শহীদ উদ্দিন চৌধুরী ও মাহিয়া সুলতানা।
তিনি থাইংখালী বাজারে ১৩ শতক জমি দান করেছেন, যার বাজারমূল্য কোটি টাকারও বেশি। তাঁর পরিবার অসংখ্য স্কুল, মাদ্রাসা ও মসজিদের জন্য জমি দান করেছে—যা আজও স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে।
মানবসেবা ও সমাজকল্যাণে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন— সাউথ এশিয়ান এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ – আঞ্চলিক সম্প্রীতি রক্ষায় ভূমিকার জন্য। মাদার তেরেসা অ্যাওয়ার্ড, সমাজসেবা ও মানবিক কর্মকাণ্ডে অনন্য অবদানের জন্য।
উখিয়া–টেকনাফের জনগণের মধ্যে এখন একটাই আলোচনা,চেয়ারম্যান গফুর এবার সংসদে যাচ্ছেন কি?”তাঁর উত্তর সহজ ও দৃঢ়
জনগণই আমার আসল দল, তাদের ভালোবাসাই আমার রাজনীতির প্রেরণা।
রাজনীতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও মানবিক নেতৃত্বের যে দৃষ্টান্ত তিনি রেখে চলেছেন—তা হয়তো এই অঞ্চলের রাজনীতিকে এক নতুন ধারায় নিয়ে যেতে পারে।
স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, উখিয়া-টেকনাফ আসনে গফুর উদ্দিন চৌধুরীর প্রার্থিতা ভোটের সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে। কারণ, আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকের একটি বড় অংশ ইতোমধ্যেই তার প্রতি সহানুভূতিশীল। ফলে শাহজাহান চৌধুরী (বিএনপি) ও নুর আহমদ আনোয়ারি (জামায়াত)-এর মধ্যে যে দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছিল, সেখানে গফুর উদ্দিন চৌধুরীর আগমন এবার নির্বাচনী মাঠে ত্রিমুখী উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।