
ড.প্রসেনজিৎ কর্মকার
কলকাতার এক ভাঙাচোরা পাড়ার ছোট ঘরে অরুণ বসে থাকে—
চা বিক্রেতা বাবার ছেলে, একসময় পার্টি মিটিংয়ে চেয়ার পাতার কাজ করত।
লোকজন বলত, “ওসব করে কী হবে? ওরা তোকে চিনবেও না।”
অরুণ হেসে বলত, “চেনার দরকার নেই, আমি নিজেকে চিনতে চাই।”
পার্টি অফিসে রাতভর ব্যানার বাঁধা, প্যাম্পলেট ছাপা, নেতা এলে জল দেওয়া—
সবটাই করত নিজের মতো নিষ্ঠায়।
ভালো জামা পরার ইচ্ছে থাকত, কিন্তু পয়সা ছিল না।
তাই প্রতিদিন ভোরে একটা পুরনো ঘটিতে কয়লা ঢেলে জামাটা ইস্তিরি করত—
গরম ধোঁয়ায় ভিজে যেতো আঙুল, তবু মন গরম থাকত।
অরুণ সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে ভাবত,
“একদিন আমিও বলব কিছু, যেটা অন্যরা শুনবে।”
তবে তখনও কেউ তাকে গুরুত্ব দিত না।
সভা শেষে ঝাঁট দিত, চেয়ার তুলত, এক কোণে দাঁড়িয়ে শোনত নেতাদের কথা।
বছরের পর বছর কেটে গেল।
সবাই বদলে গেল—কেউ বিদেশে, কেউ প্রাইভেট অফিসে।
অরুণ রয়ে গেল পাড়ার ছেলে, কিন্তু তার চোখে এক অন্য আলো জ্বলতে লাগল।
সে খবরের কাগজে লেখা শুরু করল, রাত জেগে পড়ত নীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান।
ধীরে ধীরে দলের লোকেরা খেয়াল করল—
এই ছেলেটা শুধু শ্রমিক নয়, চিন্তাশীলও।
আজ, দশ বছর পরে অরুণ দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চের সামনে,
লাল-সবুজ ব্যানারের নিচে—
যেখানে সে একসময় চেয়ার পাতত,
আজ সেখানেই মাইক হাতে বক্তৃতা দিচ্ছে।
লোকেরা বলে, “বাহ! ভাগ্য সহায়।”
কিন্তু অরুণ জানে, ভাগ্য আসলে সেই ছাইয়ের নিচে লুকানো আগুন,
যেটা প্রতিদিনের ঘষা-মাজার পরেই জ্বলে ওঠে।
মঞ্চ থেকে নামার সময় এক নবীন কর্মী এগিয়ে এসে বলে,
“দাদা, আমিও তো এখন চেয়ার পাতি, মনে হয় কোনোদিন কিছু হবে না।”
অরুণ হেসে তার কাঁধে হাত রাখে,
“ভাই, কাজটা যত ছোটই হোক, যদি নিষ্ঠা থাকে, তুইও একদিন আলাদা আলোয় জ্বলবি।
শুধু শান দিতে থাক নিজের ইচ্ছে, নিজের দক্ষতাকে।”
সন্ধ্যার সূর্য ডুবে যাচ্ছিল,
কিন্তু অরুণের চোখে তখনও আলো—
কারণ সে জানে,
যে ছাইয়ের নিচে আগুন আছে, তাকে কেউ নিভিয়ে রাখতে পারে না।