
ড.প্রসেনজিৎ কর্মকার
বিকেলের আলোটা আজ খুব কোমল। জানালার পাশে বসে থাকা অরিজিৎ যেন অনেক বছর পর রোদের এই উষ্ণতাকে অনুভব করছে। হাসপাতালের সাদা চাদরের ওপর পড়ে থাকা আলোটা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার অফিসের সেই কাচের ঘরটার কথা — যেখানে সূর্যের আলোও ঢুকতে পারত না, শুধু মিটিং আর ডেডলাইন।
একসময় কর্পোরেট জগতের এক পরিচিত মুখ ছিল অরিজিৎ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ততা, মিটিং, প্রেজেন্টেশন, টার্গেট—এই নিয়েই চলত তার জীবন। ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, ঘুমহীনতা—সবই তার কাছে ছিল “ছোটখাটো অসুবিধা”। পদোন্নতি, বোনাস আর “সিইও” চেয়ারের স্বপ্নে সে এগিয়ে চলেছিল অক্লান্ত পরিশ্রমে।
স্ত্রী মীতা বহুবার বলেছিল,
— “তুমি একটু বিশ্রাম নাও অরিজিৎ, বাচ্চারা তোমাকে মিস করে।”
কিন্তু অরিজিৎ তখন হাসত—
— “এখন কষ্ট করছি যাতে ওরা ভালো থাকে মীতা। সময় পেলে একদিন ঘুরব সবাই মিলে, বড় করে।”
সে ‘একদিন’-টা আর আসেনি।
হঠাৎ একদিন মিটিং চলাকালীনই অরিজিৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ধরা পড়ে, তার হৃদপিণ্ডের একাংশ প্রায় অকেজো। সেই দিন থেকেই অফিস নয়, হাসপাতালই তার নতুন ঠিকানা।
আজ ছ’মাস কেটে গেছে। অরিজিৎ জানে, তার সময় খুব বেশি নেই। ওষুধ, অক্সিজেন, আর শূন্য হাসপাতালের গন্ধ — এটাই তার প্রতিদিনের সঙ্গী।
আজ হঠাৎ তার কলেজের বন্ধু অনিরুদ্ধ দেখা করতে এসেছে। হাতে এক কাপ চা।
অরিজিৎ তাকিয়ে বলল —
— “অনিরুদ্ধ, মনে আছে তো? কতবার তোর সঙ্গে আড্ডায় বসব বলেছি, কিন্তু সময় পাইনি!”
অনিরুদ্ধ মৃদু হেসে বলল —
— “সময় তো ছিল, শুধু অগ্রাধিকার ছিল না।”
এই কথাটা বুকের মধ্যে ছুরি হয়ে বিঁধল অরিজিতের।
চুপচাপ তাকিয়ে রইল জানালার দিকে। মনে পড়ল, একসময় মেয়ে রূপা বলত, “বাবা, স্কুলে আমার নাচ আছে, তুমি আসবে?”
সে বলত, “আজ মিটিং আছে, পরের বার যাব।”
কিন্তু সেই “পরের বার” আর আসেনি।
অরিজিৎ এখন বুঝতে পারে—
যে সম্পত্তি, যে গাড়ি, যে পদবী — সব আজ নিষ্প্রাণ।
যে বাড়িটা বানাতে জীবনের অর্ধেকটা কেটেছে, সেখানে এখন নিঃসঙ্গতা ছাড়া কিছুই নেই।
যে অফিসে প্রতিদিন রাত পর্যন্ত থেকেছে, সেখানে আজ কেউ তার খোঁজও নেয় না।
মীতা একদিন চুপচাপ বলেছিল—
— “তুমি জানো, টাকা দিয়ে আমরা কত কিছু কিনেছি, কিন্তু তোমার হাসিটা কিনতে পারিনি।”
অরিজিতের চোখ ভিজে যায়। মনে হয়, যেন জীবনের হিসেবের খাতা খুলে গেছে সামনে।
যে বন্ধুর সাফল্যে একদিন ঈর্ষা করেছিল, আজ সে-ই তার পাশে দাঁড়িয়ে চা ধরিয়ে দিচ্ছে।
যে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি, আজ তাদের অশ্রুতে নিজের অপরাধ ধুয়ে যাচ্ছে।
রাত গভীর হয়। জানালার বাইরের আলো নিভে আসে ধীরে ধীরে।
অরিজিৎ ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলে—
— “মীতা, জানো? সারা জীবন ধরে যা যা কিনতে চেয়েছিলাম, তার কিছুই আমার বিছানার পাশে নেই। কিন্তু তোর মুখটা, রূপার হাসিটা—এই দুটোই যদি পাই, তবু জীবনটা সার্থক।”
মীতা হাত ধরে বসে থাকে। চোখে জল, মুখে শান্তি।
হাসপাতালের মনিটরে স্থির আলোর রেখা জ্বলজ্বল করে ওঠে, তারপর ধীরে ধীরে নিভে যায়।
অরিজিতের মুখে তখন এক চিলতে প্রশান্তির হাসি।
মনে হয়, জীবনের সব হিসেব মিটে গেছে অবশেষে।
শেষ বেলায় সত্যিই বোঝা যায়—
সাফল্যের মাপকাঠি পদবী নয়,
বরং কতগুলো হৃদয়ে তুমি জায়গা করে নিতে পেরেছ, সেটাই জীবনের আসল জয়।