শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৪৪ পূর্বাহ্ন

আজ সেই ভয়াল ১৫ নভেম্বর ১৮ বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি উপকূলবাসী

Coder Boss
  • Update Time : শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫
  • ৫ Time View

 

এস. এস. এম. সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি:

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর—দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনে এক বিভীষিকাময় রাত। ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডর মাত্র কয়েক ঘণ্টায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা ও ঝালকাঠিসহ উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। এখনো সেই রাতের স্মৃতি মনে পড়লে আঁতকে ওঠেন বেঁচে থাকা মানুষগুলো। পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে নির্মিত না হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছে উপকূলীয় এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। সিডরের পর বহু পরিবার আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।। উপকূলবাসীর ইতিহাসে বিভীষিকাময় একটি দিন। এই দিনটি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে এখনও এক দুঃস্বপ্ন। ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে সেদিন উপকূলীয় এলাকা দেখেছিলো ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল হাজারো মানুষ। নিখোঁজ হয়েছিল আরও সহস্রাধিক। রাত তখন প্রায় দশটা। হঠাৎ ঝড়ের গর্জন, ঢেউয়ের গর্জামুখর সাগর, আর মুহূর্তেই মৃত্যু নেমে আসে দক্ষিণ উপকূল জুড়ে।এদিন বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় সিডর। আঘাতের সময় সিডরের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। তবে এ সময় দমকা হাওয়ার বেগ উঠছিল ঘণ্টায় ৩০৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। সিডরের প্রভাবে উপকূলে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়।
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ সে রাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল পুরো বাগেরহাট,বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা ও ঝালকাঠির বিস্তীর্ণ এলাকা।
১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ক্ষত আজও শুকোয়নি উপকূলের মানুষের মনে, জীবনে ও জমিনে।

২০০৭ সালের এই দিনে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সামুদ্রিক ঝড় ‘সিডর’ আঘাত হানে বাগেরহাট,বরিশাল, বরগুনাসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায়।স্মরণকালের প্রলয়ঙ্কারি ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। দানবরূপি ঝড়-জলোচ্ছাসে মোরেলগঞ্জ শরণখোলাতেই মারা যায় ২ হাজারেরও বেশি মানুষ। বিধ্বস্ত হয় অসংখ্য গাছপালা, ঘরবাড়ি। টেকসই ভেড়িবাঁধ না থাকায় সেদিন জলোচ্ছাসের তোড়ে মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপূরী আর ধ্বংসস্তূপে পরিণত মোরেলগঞ্জ শরণখোলা।
সিডরের পর স্বজন আর সহায় সম্বলহারা মানুষের একটাই দাবি ছিল ‘ আমরা ত্রাণ চাইনা, টেকসই ভেড়িবাঁধ চাই,। এই দাবিতে কয়েক বছর ধরে চলে আন্দোলন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে এসে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয় টেকসই ভেড়িবাঁধের কাজ। বলেশ্বর নদের তীররক্ষায় প্রায় ২০ কিলোমিটারসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের মোট ৬২ কিলোমিটার বাঁধের কাজ শেষ হয় ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর। উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি-১) মাধ্যমে সিএইচডব্লিউই নামে চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এই কাজ বাস্তবাণ করে। কিন্তু নদী শাসনের ব্যবস্থা না করে বাঁধ নির্মাণ এবং কাজে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হওয়ায় হস্তান্তরের পর বছর যেতে না যেতেই সেই বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বলেশ্বর নদের তীরে সাউথখালী ইউনিয়নের বগী থেকে মোরেলগঞ্জ সীমানার সন্ন্যাসীর ফাসিয়াতলা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ৯ কিলোমিটার মূল বাঁধসহ সিসি ব্লক ধসে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এমন ভয়াবহ ভাঙন দেখে মোরেলগঞ্জ শরণখোলাবাসীর আক্ষেপ, সিডরের১৮ বছর পর এসেও বাঁধ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে। আতঙ্কে দিন কাটছে বলেশ্বর নদের তীরের বাসিন্দাদের। নদী তীরবর্তী গাবতলা গ্রামের বাসিন্দা মিজান হাওলাদার, দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের আলমগীর হোসেন, জাহাঙ্গীর খান, উত্তর সাউথখালী গ্রামের আনোয়ার হাওলাদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টেকসই ভেড়িবাঁধ ছিল না বলে সিডরে আমরা স্বজন হারিয়েছি। ঘরবাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে একটি টেকসই ও উঁচু ভেড়িবাঁধ চেয়েছিলাম। উঁচু বাঁধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা টেকসই হয়নি। নদী শাসন না করে বাঁধ নির্মাণ করায় বছর না যেতেই ভাঙন শুরু হয়েছে। দ্রুত নদী শাসনের ব্যবস্থা করা না হলে দুই-তিন বছরের মধ্যেই বাঁধ ভেঙে বিলীন হয়ে যাবে।ভাঙন কবলিত সাউথখালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র আনোয়ার হোসেন পঞ্চাতে বলেন, নদী শাসন ছাড়া টেকসই বাঁধ হওয়া সম্ভব নয়। তৎকালীন সরকার ও বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাঁধ নির্মাণে নদী শাসনের ব্যাবস্থা না রেখে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে। ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এখানে। মাটির বদলে নদীর বালু ব্যবহার করা হয়েছে। এতে শুধু বাঁধ উঁচুই হয়েছে, কিন্তু টেকসই হয়নি। দ্রুত নদী শাসন না করলে টই কোনোভাবে টিকবে না। বর্তমান সরকারের কাছে দুর্নীতি তদন্ত ও নদী শাসন করে বাঁধ রক্ষার দাবি জানান এই বিএনপি নেতা।
নদী শাসন এবং ধসে যাওয়া বাঁধ ও সিসি ব্লক মেরামতের ব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মাদ আল বিরুনী বলেন, বলেশ্বর নদের তীররক্ষা বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পূর্ণ এলাকার নদী শাসন করতে হলে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। আপাতত জাইকার অর্থায়নে স্বল্প পরিসরে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি পাস হলে চলতি মাসের শেষের দিকে কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। সহায়সম্বল ও স্বজন হারানো মানুষগুলো ফিরে যেতে পারেনি তাদের স্বাভাবিক জীবনে। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য আজও নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

সিডরের ছোবলে দক্ষিণের উপকূলীয় জেলাগুলো পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। প্রিয়জনকে হারিয়ে এখনো এই দিন আসলে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। সিডরের ক্ষতচিহ্ন বহন করে চলেছেন অনেকে।

তবে যারা সিডরের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের যোদ্ধা বলে দাবি করেন। কেননা সিডরের পর উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আইলা ও নার্গিস নামের ঘূর্ণিঝড়কে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছেন।

২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর সারা দেশের আকাশ ছিল মেঘলা। আবহাওয়াবিদরা প্রথমে ৫ নম্বর সংকেত দিতে থাকেন। রাতে তা ৮ নম্বর বিপদ সংকেতে গিয়ে পৌঁছায়। ১৫ নভেম্বর সকালে ঘোষণা করা হয় সিডর নামের ঘূর্ণিঝড় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের উপকূলে। দুপুর নাগাদ তা বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করবে। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত।সিডরের ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত ধকল কাটেনি উপকূলবাসীর। ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন নিহতের স্বজনরা। ঘরবাড়ি আর সহায় সম্বল হারানো মানুষ সেই ক্ষতি এখনও পুষিয়ে উঠতে পারেননি।সন্ধ্যার পর থেকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের গতি বাড়তে থাকে। রাত ৯টার দিকে সিডর প্রথম আঘাত হানে সুন্দরবনের কাছে দুবলারচরে। এরপর বরগুনার পাথরঘাটায় বলেশ্বর নদের কাছে উপকূল অতিক্রম করে। সিডরের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বরিশাল ও খুলনা বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চল। ধ্বংসযজ্ঞ চলে বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, ঝালকাঠিসহ দেশের প্রায় ৩১টি জেলায়।

সিডরের প্রভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। গাছপালা উপড়ে যায়। দেশের বিদ্যুৎ–ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে নগরগুলোর পানি সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

সিডরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হিসেবে চিহ্নিত হয় বাগেরহাট আর বরগুনা। সরকারি হিসাবে বাগেরহাট জেলায় নিহত হন ৯০৮ জন ও আহত হন ১১ হাজার ৪২৮ জন। বরগুনা জেলায় মারা যান ১ হাজার ৩৪৫ জন। নিখোঁজ ছিলেন ১৫৬ জন।সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা ছিল বাগেরহাটের শরণখোলা। আর শরণখোলার মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাউথখালী ইউনিয়ন। শরণখোলা ছাড়াও বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ ও মোংলা উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়।সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা ছিল বাগেরহাটের শরণখোলা। আর শরণখোলার মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাউথখালী ইউনিয়ন। শরণখোলা ছাড়াও বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ ও মোংলা উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়।

সিডর আক্রান্ত এলাকায় জায়গার অভাবে গণকবর দিতে হয়। অনেক লাশের কোনো পরিচয়ও পাওয়া যায়নি। কাপড়ের অভাবে অনেক মরদেহ পলিথিনে মুড়িয়ে দাফন করা হয়। ঘটনার এক মাস পরেও ধানখেত, নদীর চর, বেড়িবাঁধ, গাছের গোড়া আর জঙ্গলের নানা আনাচকানাচ থেকে লাশ, লাশের অংশবিশেষ অথবা কঙ্কাল উদ্ধার হয়। কেউ কেউ সিডর আঘাত হানার অনেক দিন পর স্বজনদের কাছে ফিরেও আসেন। স্মৃতি হারিয়ে অনেকেই আর গ্রামের বাড়ি খুঁজে পাননি। ফিরতে পারেননি।

সিডর আক্রান্ত এলাকায় জায়গার অভাবে গণকবর দিতে হয়। অনেক লাশের কোনো পরিচয়ও পাওয়া যায়নি। কাপড়ের অভাবে অনেক মরদেহ পলিথিনে মুড়িয়ে দাফন করা হয়। ঘটনার এক মাস পরেও ধানখেত, নদীর চর, বেড়িবাঁধ, গাছের গোড়া আর জঙ্গলের নানা আনাচকানাচ থেকে লাশ, লাশের অংশবিশেষ অথবা কঙ্কাল উদ্ধার হয়। কেউ কেউ সিডর আঘাত হানার অনেক দিন পর স্বজনদের কাছে ফিরেও আসেন। স্মৃতি হারিয়ে অনেকেই আর গ্রামের বাড়ি খুঁজে পাননি। ফিরতে পারেননি।

এ জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১ পরিবারের মধ্যে বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮৫টি, ফসলের ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৩ একর, গবাদি পশু মারা গেছে ৩০ হাজার ৪৯৯টি, ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ২৩৫টি, ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ৪২০ কিলোমিটার। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্য আরও বেশি।সরকারি হিসাবে সিডরে ১ হাজার ১ জনের নিখোঁজের কথা বলা হয়েছিল। তবে প্রকৃত নিখোঁজের সংখ্যা এর দ্বিগুণ বা তার বেশি হতে পারে বলে উপকূলবাসী তখন ধারণা করেছিল।

লাশ পাওয়া না গেলে ব্যক্তি আইনের চোখে নিহত হিসেবে গণ্য হন না। খয়রাতি ক্ষতিপূরণের হকদার হতে পারে না তাঁর পরিবার। নিখোঁজ জলদাসদের স্ত্রীরা শাঁখা হাতে বিধবা বধূর জীবন যাপন করেন। পাথরঘাটার লাশ না পাওয়া ৪৬ জন জেলেকে শেষ পর্যন্ত আর মৃত ঘোষণা করা হয়নি। আজ পর্যন্ত তাঁদের কেউ ফিরেও আসেননি।

পাথরঘাটার বাদুড়তলা গ্রামের নিখোঁজ জেলে জাকির হোসেনের স্ত্রী মাসুরা বেগম তাঁর চার মেয়েকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। এক মেয়ে মারা গেছে। আর বাকি তিন মেয়েকে তিনি অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। নিখোঁজের স্ত্রী বিধবা নন, তাই তিনি বিধবা ভাতার হকদার নন।

পাথরঘাটার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ হাসানের বাবাও সিডরে নিখোঁজ। হাসান পড়ছে স্থানীয় বারি আজাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বাবার কোনো স্মৃতি তার মনে পড়ে না। ২০০৭ সালে হাসান কেবল হাঁটা শিখেছিল। মায়ের কাছে শুনেছে, বাবা তার হাত ধরে উঠানে হাঁটতেন। তার বড় সান্ত্বনা তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করে তাকে ছেড়ে চলে যাননি। বাবা থাকলে করোনাকালে স্মার্টফোনের অভাবে পড়াশোনায় সে পিছিয়ে যেত না। মা মর্জিনা কোনো ভাতা পান না। দিনমজুরি করে ছেলেকে পড়াচ্ছেন। মর্জিনার মতো অনেক মা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন নিজেদের চেষ্টায়।

সিডরের দুদিন আগে সাগরে মাছ ধরতে যান বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হোসেন আলী (ছদ্মনাম)। সেদিন যখন ফজরের ওয়াক্তে সাত জেলের সঙ্গে সাগরে যাত্রা করেন, তখন তাঁর ১০ বছরের মেয়ে আর ৫ বছরের ছেলে ঘুমিয়ে ছিল। দীর্ঘ ১৪ বছরে তিনি ফেরেননি। নিখোঁজের স্ত্রী আজিজা বেগমের (ছদ্মনাম) নতুন জীবনযুদ্ধ শুরু হয় সেই ২০০৭ সাল থেকে। দুই সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে নেন আজিজা। তাঁর মেয়ে এখন রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন। ছেলে এখন স্নাতকে ভর্তির অপেক্ষায় রয়েছেন।
নিখোঁজদের কেউ কি ফেরে

সিডরে নিখোঁজ হওয়ার সাড়ে ৯ বছর পরে বাড়িতে ফিরে আসেন আমতলীর ঘটখালী গ্রামের এনসান আলীর ছেলে সোহেল (২৮)। কিন্তু তাঁর বাক্‌শক্তি নেই। কোথা থেকে কীভাবে ফিরে এসেছেন, কেউ বলতে পারে না। নিখোঁজ সোহেল ফিরে আসার পরে পরিবারের লোকজন চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ফল মেলেনি।

সিডরের ১০ বছর পর ফিরে আসেন বরগুনার তালতলী উপজেলার তেতুঁলবাড়িয়া গ্রামের জেলে হানিফ গাজী। তাঁর ফিরে আসার গল্পটি এমন, তেতুঁলবাড়িয়া ও জলায়ভাঙ্গা এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় এক ব্যক্তি ঘোরাফেরা করছিলেন। শুক্কুর গাজী ভাত খাওয়ানোর কথা বলে তাঁকে বাড়ি নিয়ে যান। বাড়ির মেয়েরা দেখে চিনতে পারেন এই ব্যক্তিই হারিয়ে যাওয়া হানিফ।

হানিফের বাবা মেনসের গাজী বাড়ি ফিরে ছেলেকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেননি। পরে ছেলের নাভির ওপর পোড়া ও পিঠে কালো দাগ দেখে নিশ্চিত হন, ছেলেটি তাঁরই সন্তান। হানিফ কিন্তু সোহেলের মতো বাকরুদ্ধ। এখন তিনি শুধু বাবার নাম একটু একটু বলতে পারেন।

শরণখোলা বাজার থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী এক যুবককে তাঁর পরিবার পিরোজপুরে নিয়ে গেছে গত বছর। ১৩ বছর ধরে এই যুবক ঘুরে বেরিয়েছেন শরণখোলার পথে পথে।
সামাজিক সুরক্ষা কেন নয়

সাইক্লোনে যেসব মা-বাবা নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁদের সন্তানদের নিকটতম আত্মীয়দের কাছে রেখে বিকাশকে অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নিয়েছিল দেশের শিশু অধিকার সংগঠনগুলো। জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) তখন এগিয়ে এসেছিল। পরে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ কর্মসূচির নেতৃত্ব দেয়।

‘আমাদের শিশু’ নামের সেই কর্মসূচি নিখোঁজ জেলেদের অনেক শিশুকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সহায়তা করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সফলতার সঙ্গে পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছে। সবাই পারেনি। অনেকেই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। অনেকে শিশুশ্রমে বাধ্য হয়েছে। হারিয়ে গেছে সরকারি তালিকা থেকে।

এই মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনে আতঙ্কিত মানুষ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে বইছে দমকা হাওয়া। সচেতন কিছু মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে শুরু করলেও বেশির ভাগ মানুষ থেকে যায় নিজ বাড়িতে। রাত ১০ টার দিকে প্রবল বাতাসের সঙ্গে যুক্ত হলো জলোচ্ছ্বাস। অবশেষে এটি বাংলাদেশে আঘাত হানে ১৫ নভেম্বর রাত ৯টায়।ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও মাছ ধরতে গিয়ে দুর্ঘটনায় সাগরেই নিহত হচ্ছেন অনেক জেলে। তাঁরা নিখোঁজ বলে গণ্য হচ্ছেন। তাঁদের একটা বিমার আওতায় আনা কি খুবই কঠিন? নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্ত্রীরা কেন কোনো সামাজিক সুরক্ষাবলয়ের সাহায্য পাবেন না? হানিফ, সোহেল বা কাসেমের মতো ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কেন আট বছর, নয় বছর রাস্তায় রাস্তায় বাকরুদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ‘রোল মডেল’ বাংলাদেশে?

নিমেষেই উড়ে গেল ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা। বঙ্গোপসাগরের সব পানি যেন যমদূত হয়ে ভাসিয়ে নিল হাজার হাজার মানুষ। মাত্র কয়েক মিনিটে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল গোটা এলাকা। পরের দিন দেখা গেল চারদিকে শুধুই ধ্বংসলীলা। উদ্ধার করা হলো লাশের পর লাশ। দাফনের জায়গা নেই, রাস্তার পাশে গণকবর করে চাপা দেওয়া হলো বহু হতভাগার লাশ। স্বজন আর সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল উপকূল এলাকার কয়েক লাখ মানুষ।

দেশের উপকূল সুরক্ষায় ১২৩টি পোল্ডারের অধীনে পাউবোর পাঁচ হাজার ১০৭ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৯৫৭ কিলোমিটার হচ্ছে সমুদ্র-তীরবর্তী বাঁধ। সমুদ্রের তীরবর্তী এ বাঁধের সিংহভাগই বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলার আওতায়। সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সিডরে উপকূলীয় অঞ্চলের দুই হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিলো প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ছয় জেলার প্রায় ১৮০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ এবং এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সিডরে বেড়িবাঁধ ভেঙে নোনা পানি ঢোকায় তাৎক্ষণিকভাবে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়া জমির পরিমাণ ছিলো ১১ লাখ ৭৮৭ হেক্টর। মৃত্যু ঘটে ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬০টি হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর। জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে যাওয়া এবং বিধ্বস্ত হওয়া সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল ৮ হাজার ৭৫ কিলোমিটার। ক্ষতিগ্রস্থ হয় ১ হাজার ৬৮৭টি ব্রিজ-কালভার্ট। তাৎক্ষণিকভাবে ৪ হাজার কোটি টাকার ফসলহানির হিসের দেয় কৃষি বিভাগ।

সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩০ জেলার ২০০ উপজেলা। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা বলা হয় ৩৩৬৩ জন। তবে বেসরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা আরো বেশি।ভয়াবহ বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সড়ক, নৌ, বিদ্যুৎ এবং টেলিযোগাযোগসহ আধুনিক সভ্যতার সার্বিক অবকাঠামো। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রকৃতির এ ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখে শিউরে ওঠে গোটা বিশ্ব। সাহায্যের হাত বাড়ায় দেশি-বিদেশিরা। সময়ের আবর্তনে বছর ঘুরে ঘুরে এসেছে সেই দিন। স্মৃতিচারণে চাপা কান্না আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের উদ্দেশে বহু জায়গায় আয়োজন করা হবে দোয়া ও মোনাজাতের।

১৫ নভেস্বর সিডরে স্বজন হারা উপকূলের মানুষেরা মিলাদ মাহফিল, দোয়া মোনাজাত, কোরআনখানি ও নানাবিধ পারিবারিক আয়োজনে দিনটিকে স্মরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

More News Of This Category
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102