প্রতি বছর এসব জলাশয়ে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এ বছর সরালি, ছোট জিড়িয়া, বামুনিয়া হাঁস ও বক জাতীয় পাখির সংখ্যা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ছাড়া পর্চাড, ফাইফেচার, গার্গেনি, লাল মুড়ি, মুরহেন, নর্দান পিনটেইল, জলপিপি, নকতা, চিতাটুপি, কোম্বাডাক, বালিহাঁস, খয়রা, চকাচকি, কারিউ, হেরন, নিশাচর, কাদাখচা, গায়ক রেনপাখি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল ও নরদামসহ রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, চিতি, পেরিভূতি, নীলশীর পিয়াং, রাঙামুড়ি, গিরিয়া, পানিমুরগি, নর্তগিরিয়া, পাতি বাটন, কমনচিল, কটনচিল, বৈকাল, পাস্তমুখী, লেনজা প্রভৃতি।
প্রতি বছর শীত মওসুম এলেই আমাদের দেশের জলাশয়, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর ভরে যায় বিভিন্ন প্রজাতির রঙ-বেরঙয়ের অতিথি পাখি দিয়ে। পাখিদের মাঝে রঙ, বর্ণ, জাত-ভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ঐক্যের বন্ধনে অটুট থাকতে দেখা যায়। পাখিদের ভ্রাতৃত্ব বোধ আর ঐক্যের কারণে আমরা তাদের অতিথি পাখি বলি। নামে অতিথি পাখি হলেও ঝাঁকে ঝাঁকে এসব অতিথি পাখি শীতকালে হাজির হয় আমাদের দেশে। নিজেদের শীত থেকে বাঁচানোর জন্য। পাখিরা প্রকৃতির বন্ধু। তাই এদের রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।
শীত আসলে কী কী জিনিস সঙ্গে আসবেই বলো দেখি। লেপ, কম্বল, পিঠা, ছুটি, বেড়ানো আর? আর হলো অতিথি পাখি।
আমরা প্রায় সবাই অতিথি পাখির সঙ্গে কম বেশি পরিচিত। শীতকালে কত দূর দেশ থেকে শীতের পাখিরা আমাদের দেশে বেড়াতে আসে। এই জন্য আমরা এই পাখিদের অতিথি পাখি বলে থাকি। তবে পাখিরা কিন্তু আমাদের দেশে বেড়াতে আসে না। আসলে পাখিদের জীব ঠিক আমাদের মতোও নয়। ওদের জীবন অনেক বেশি দৈহিক প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে হয়। শীতে আমরা যখন মজা করে ঘুরতে বের হই ওদের তখন নিজেদের জীবন বাঁচানোর তাগিদে ছুটতে হয়।
অতিথি পাখিরা মূলত যেসব দেশ থেকে আমাদের দেশে আসে সেসব দেশ শীত প্রধান। আমাদের দেশে যখন আরামদায়ক ঠাণ্ডা পরে ওদের দেশে তখন রক্ত জমিয়ে দেওয়ার মতো কনকনে ঠাণ্ডা। এত ঠাণ্ডা আমাদের চিন্তারও বাইরে। আকাশ থেকে বরফ পড়ে, মাটি বরফে ঢেকে যায়। তাপমাত্রা অনেক কমে যায়।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ফলে যে শুধু পাখিদের থাকতে কষ্ট হয় তাই নয়। শীতে ঐসব অঞ্চলে সব গাছ ঘুমন্ত অবস্থায় চলে যায়। তখন গাছে আর কোনো পাতা থাকে না। শুকনো ডালগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে যেসব পোকামাকড় খেয়ে পাখিরা বেঁচে সে পোকামাকড়গুলো বেঁচে থাকে এইসব গাছের পাতার উপর। শীতকালে তারাও গাছের পাতা খেতে না পেয়ে মরে যায় বা এদিক সেদিক চলে যায়। তাই পাখিদের জন্য তখন প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা যায়। আবার যেসব পাখি জলজ প্রাণী যেমন মাছ খেয়ে বাঁচে তাদের জন্য তো আরও সমস্যা। পানি তো জমে বরফ। পাখিরা কীভাবে সেখানে চড়ে বেড়াবে আর কীভাবেই বা মাছ খুঁজবে?
অধিকাংশ পরিব্রাজক পাখি মানে যারা শীতে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য দেশে চলে আসে তাদের বাচ্চা দাওয়ার সময়টাই ঐ শিত। কিন্তু এমন বৈরী পরিবেশে যদি বাচ্চা জন্ম দেয় তাহলে আর ওরা কীভাবে বেঁচে থাকবে? তাই বেঁচে থাকার তাগিদে পাখিগুলো নিজের দেশ ছেড়ে এমন কোন দেশে চলে আসে যেখানে শীত তুলনামূলক উষ্ণ আর আরামদায়ক।
শীতের দেশের ভয়ংকর শীত যখন পরতে আরম্ভ করে তখন এইসব শীতের দেশের পাখিরা ঝাঁক বেঁধে রওনা দেয়। তুলনামূলক অভিজ্ঞ আগে গরমের দেশে গিয়েছে এমন পাখিরাই সামনে দাঁড়িয়ে বাকিদের পথ দেখায়। তবে এটাও দেখা গিয়েছে যে ঝাঁকের মধ্যে কিছু পাখি দলছুট হয়ে যায়। তারা বয়সে নবীন হলেও ঠিকঠাক খুঁজে গরমের দেশে আসতে পারে।
পাখিরা কীভাবে এত দীর্ঘ পথ খুঁজে খুঁজে পাড়ি দেয় এটা নিয়ে বিজ্ঞানীদের নানান মত আছে। কেউ কেউ মনে করেন পাখিরা সূর্য, চন্দ্রের অবস্থান। পাখিরা পাহাড় নদী সমুদ্র ইত্যাদিকে চিহ্ন ধরে এগিয়ে পথ খুঁজে নেয়। তবে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের আবেশ পাখিরা তাদের মস্তিষ্ক দিয়ে অনুভব করতে পারে। আর এভাবেই তারা ঠিক ঠিক পথ খুঁজে গরমের দেশে চলে আসে।
গরমের দেশে শীতের সময় দিব্যি নতুন গাছ জন্মায়, ফসল হয়, জলাশয়ে পানি থাকে, পানিতে মাছ থাকে। সেগুলো খেয়ে বেশ আরাম করে বেঁচে থাকা যায়।
শীতের সময় তোমরা যদি হাওড় বা বিল অঞ্চলে যাও তবে দেখবে কত যে পাখি সেখানে বসে আছে। গরমে এদের খুঁজেই পাবে না।
আমাদের দেশে শীতের একটা সৌন্দর্য হলো এইসব পাখি। আর পাখিগুলো দেখতে যেমন চমৎকার খুব সুন্দর তাদের নামও খুব সুন্দর যেমন কালো হাঁস, নীলশির, লালশির, খয়েরীডানা পাপিয়া।
এ পাখিগুলো যে শুধু সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের দেশে আসে তা কিন্তু নয়। এই পাখিগুলোর সঙ্গে অনেক অসুখ-বিসুখও আসে। পরিব্রাজক প্রাণীরাই দুনিয়াব্যাপী রোগের বিস্তার করে। যেমন এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, যে ভাইরাস বার্ড ফ্লুর জন্য দায়ী, এটা এইসব পরিব্রাজক পাখির মাধ্যমেই দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে পরে।
তবে সব পাখি যে অসুখ নিয়ে আসে এমন নয়। খুব কম পাখিই অসুখ বহন করে। অধিকাংশ পাখিই স্বাভাবিক হয়।
আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে একটা প্রথা চলে আসছে যে শীত আসলেই সবাই পাখি শিকারে বের হয়। এমন করে করে মানুষ পৃথিবীতে পাখির সংখ্যা অনেক কমিয়ে দিচ্ছে। পরিব্রাজক পাখিরা প্রাণী বৈচিত্র্যের দূত।
সারা পৃথিবীতেই এইসব পরিব্রাজক পাখিরা শিকারিদের কবলে পরে। তাদের রক্ষার বিষয়ে সচেতনতার জন্য ২০০৬ থেকে মে মাসের ১০ ও ১১ তারিখকে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস হিসেবে পালন করা হয়।