কৃষকের এই শহীদের খবর পৌঁছে যায় তাঁর সহপাঠী তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন, মামলা গ্রহণ করেন এবং বহু আসামিকে কলকাতায় নিয়ে বিচার শুরু করেন। হেনরি মোরেল ধরা পড়েন বোম্বেতে, দুর্গাচরণ বৃন্দাবনে। রবার্ট মোরেল অসুস্থ অবস্থায় বরিশালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং ১৮৬৮ সালের ১৩ মে মারা যান।
মোরেলদের পতন ও স্মৃতিস্তম্ভ
রহিমুল্লাহ হত্যার জের ধরে ১৮৭৮ সালে মোরেল পরিবার গুটিয়ে নেয় তাদের শাসন। তবে তাদের নির্মাণ—‘কুঠিবাড়ি’—আজও দাঁড়িয়ে আছে সময়ের নীরব সাক্ষী হয়ে। ইংরেজ অপশাসকের স্মরণে তাঁদের অনুসারীরা নির্মাণ করেছিলেন একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যার সাদা পাথরে খোদাই করা আছে রবার্ট মোরেলের মৃত্যুবার্তা ও নির্মাতাদের নাম।
পরিত্যক্ত ঐতিহ্যের শোচনীয় অবস্থা
দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে কুঠিবাড়িটি পরিত্যক্ত। মূল্যবান দরজা-জানালা, গ্রীল, সোনা-রূপার অলংকার, পুরনো সিন্দুক, সিঁড়ি—সবই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে বা চুরি হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভটিও আজ বিকৃত, বেশ কিছু অংশ চুরি হয়ে গেছে।
কোনো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণের স্পর্শ না পেয়ে ইতিহাসের এই মহামূল্য স্মৃতিচিহ্ন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
ঐতিহ্যবাহী এই কুঠিবাড়িকে নিয়ে গবেষক প্রাক্তন অধ্যক্ষ ম্যাটস্ বাগেরহাট ডা. মো. শিব্বির আহেমদ বলেন, কুঠিবাড়ি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি আজ ধংসের দ্বারপ্রান্তে। ইতিপূর্বে অনেক জমি অবৈধ দখলদারের হাতে চলে গেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করে দেখভালের জন্য দায়িত্ব গ্রহণের দাবি জানান তিনি। পাশাপাশি কুঠিবাড়ির এ জমিতে শিশু পার্ক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে শিশুদের বিনোদনের চাহিদা লাঘব হবে। আয়ের উত্স্য থেকে সরকারিভাবে রাজস্বও আসবে। মোরেলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাবিবুল্লাহ জানান, কুঠিবাড়ি সংরক্ষণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়াও এখানে বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাসহ দৃষ্টি আকর্ষণে কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপণ করা হবে। ঐতিহাসিক এ ইংরেজ শাসনামলের ‘কুঠিবাড়ি’ সংরক্ষণে প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এলাকাবাসী।
মোরেলগঞ্জের ইতিহাসের সূতিকাগার হিসেবেকুঠিবাড়িটি সংরক্ষণের জন্য ইতিমধ্যে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। ঐতিহাসিক এ ইংরেজ শাসনামলের ‘কুঠিবাড়ি’ সংরক্ষনে প্রত্মতত্ত বিভাগে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এলাকাবাসী।
কৃষক নেতা রহিমুল্লাহর অবিস্মরণীয় বিদ্রোহ
নীলকরের অত্যাচার বাড়তে থাকলে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ান সুন্দরবনের কৃষক নেতা রহিমুল্লাহ। কলকাতা থেকে ইংরেজি শেখার চেষ্টা ছেড়ে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন এবং ভাইদের নিয়ে ১৪শ’ বিঘা জমি আবাদ করেন। খবর পেয়ে রবার্ট মোরেল খাজনা দাবি করলে রহিমুল্লাহ তা প্রত্যাখ্যান করেন। পুনরায় খাজনা চাইতে পিয়াদা পাঠানো হলে তিনি কাঠের বাক্সে ছেঁড়া জুতা পাঠিয়ে জানান দেন তাঁর প্রতিবাদ।
কূটচালে মোরেল রহিমুল্লাহর সহযোগী গুনী মামুনকে পত্তনি দেন, এবং ১৮৬১ সালের ২১ নভেম্বর রাতে শতাধিক লাঠিয়াল নিয়ে রহিমুল্লাহকে আক্রমণ করেন। পাল্টা লড়াইয়ে মোরেল বাহিনীর রামধন মালোসহ ৭–৮ জন নিহত হয়। হেনরি মোরেল ও ম্যানেজার হেইলি ধরা পড়ে রহিমুল্লাহর হাতে। অনুতাপ প্রকাশ করলে তাঁদের ছেড়ে দেন তিনি।
তবে তিনদিন পর, ২৫ নভেম্বর রাতে অস্ত্রসজ্জিত বাহিনী নিয়ে আবারও আক্রমণ করে মোরেল পরিবার। দুই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সারা রাত লড়াই করেন রহিমুল্লাহ। ভোরের আলো ফুটতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি শহীদ হন।