
কলমেঃ মোঃ নুর ইসলাম মৃধা
ধর্ম মানুষের আত্মিক উন্নতি, নৈতিকতা ও মানবকল্যাণের পথনির্দেশ। কিন্তু সমাজের বাস্তবতায় দেখা যায়, ধর্মের পবিত্রতা অনেক সময় বাণিজ্যিক স্বার্থের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। বিশ্বাসকে পুঁজি করে, আবেগকে ব্যবহার করে, ধর্মকে কেন্দ্র করে নানা শ্রেণি–পেশার মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক অদৃশ্য অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা এতটাই প্রকট যে, মানুষ সত্য–মিথ্যার পার্থক্য না বুঝেই ধর্মব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। এই কলামে ধর্মের নামে ব্যবসার বিভিন্ন দিক বাস্তবতার আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
বাউল গান ও আধ্যাত্মিকতার বাণিজ্যিক রূপান্তরঃ
বাউল দর্শন মূলত মানবতা, আধ্যাত্মিক শান্তি এবং মুক্তচিন্তার শিক্ষা দেয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাউল গানের আবেগকেও কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক পরিমণ্ডল। গান করলে পারিশ্রমিক পাওয়া যায় বলেই অনেক গায়ক এই চর্চায় যুক্ত। অর্থনৈতিক টানাপোড়েন না থাকলে হয়তো অনেকেই এই পেশায় আসতেন না। ফলে আধ্যাত্মিক শিল্পও আজ বাজার নির্ভর হয়ে গেছে—যেখানে দর্শন হারিয়ে যাচ্ছে, টাকার ঝলকানি বাড়ছে।
ওয়াজ-মাহফিল: উপদেশ নাকি ইন্ডাস্ট্রি?
ধর্মীয় জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওয়াজ হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে ওয়াজ এখন পেশা—গড়ে উঠেছে পুরো এক লাভজনক ইন্ডাস্ট্রি।
অনেক বক্তা ওয়াজে যোগদানকে ধর্মীয় দায়িত্বের চেয়ে বড় আয়ের উৎস হিসেবে দেখেন। ওয়াজ-মঞ্চে প্রতিযোগিতা, আনুকূল্য লাভ, টাকার অঙ্ক—সবই আজ প্রকাশ্য গোপন সত্য।
আবার বক্তারা যত বেশি বক্তৃতা দেন, তত বেশি জনপ্রিয় হন—এ জনপ্রিয়তার সিঁড়ি বেয়ে অনেকেই ব্যবসায়িক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।
ইমামতি: ধর্মীয় দায়িত্ব নাকি জীবিকার প্রয়োজন?
মসজিদের ইমামরা সমাজের নৈতিক দিশারি। কিন্তু বাস্তবতা হলো—ইমামতির দায়িত্বও অর্থনৈতিক স্বার্থের বাইরে নয়।
ইমামরা সম্মানী না পেলে মসজিদ পরিচালনা, পরিবার-পরিজনের খরচ—কিছুই সম্ভব হত না।
তাই ইমামতি চাকরি, আবার একইসঙ্গে একটি ‘ব্যবসায়িক পেশা’—এ যুক্তির সত্যতা অস্বীকার করা যায় না।
এতে ইমামদের দোষ নেই; দোষ কাঠামোর, যা ধর্মীয় দায়িত্বকে পেশায় রূপান্তরিত হতে বাধ্য করেছে।
মাজার সংস্কৃতির ব্যবসায়ীকীকরণঃ
দেশের নানা স্থানে মাজারকে কেন্দ্র করে বিশাল পরিসরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে। মানত, দান, পশু উৎসর্গ, দোয়া-কবুলের আশ্বাস—সব মিলিয়ে মাজার আজ বহু মানুষের জীবিকার উৎস।
অনেক খাদেম, কমিটি ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গ মাজারের পীর বা ওলিদের নামে এমন সব কেরামতির গল্প ছড়ান যা কখনো বাস্তবে ঘটেনি।
মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে ব্যবহার করে তারা যে বিশাল ব্যবসা করে—তা সমাজের মানুষ এখন স্পষ্টভাবে টের পাচ্ছে।
রাজনীতিতে ধর্ম: জনপ্রিয়তার পরীক্ষিত হাতিয়ারঃ
রাজনীতিতে ভোটের হিসাবই সব। আর মানুষের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগানো সেই ভোট-রাজনীতির অন্যতম কৌশল।
নির্বাচনী সময়ে অনেক নেতা ধর্মপ্রাণের অভিনয় করেন—মসজিদে দান, মাজার জিয়ারত, ওয়াজ উপস্থিতি—সবই ভোটের ব্যাংক বাড়ানোর পদ্ধতি। ধর্ম এখানে বিশ্বাস নয়; বরং আবেগ নিয়ন্ত্রণের শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্র।
পীর-মৌলবিতন্ত্র: অনুসারী গড়ার প্রতিযোগিতাঃ
পীরালী সংস্কৃতি সমাজে বেশ শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে।
পীরেরা যত বেশি অনুসারী পান, তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক শক্তি ততই বাড়ে। ফলে পীরতন্ত্রও আজ ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের একটি মাধ্যম। পৃথিবীর বহু দেশে পীর-মৌলবির কোনো সংস্কৃতি নেই। সেখানে ধর্ম চর্চা হয় ব্যক্তিগতভাবে, বাণিজ্যিকভাবে নয়।
বিদেশে ভিন্ন চিত্রঃ
সৌদি আরবে ওয়াজ ব্যবসার অস্তিত্ব নেই।
সেখানে ধর্ম রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হওয়ায় ওয়াজ-মাহফিল, পীর-সিস্টেম, মাজার ব্যবসা—এসবের কোনো বাজার নেই।
মসজিদের ইমামরাও অনেক সময় বিদেশি শ্রমিক—যারা ইমামতিকে আর্থিক ব্যবসা নয়, বরং চাকরির পরিপূরক ধর্মচর্চা হিসেবে দেখেন। এখানেই আমাদের সমাজ ও মধ্যপ্রাচ্যের সমাজের পার্থক্য।
ধর্মব্যবসার দ্বন্দ্ব: গিবত, ফতোয়া ও আধিপত্যের যুদ্ধঃ
যেখানে অর্থ থাকে, সেখানে প্রতিযোগিতা থাকবেই।
ধর্মের নামেও সেই প্রতিযোগিতা রয়েছে।
এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে কাফের বলে, গিবত-অপবাদ ছড়ায়, আধিপত্য বিস্তার করতে চায়।
এই সমস্ত বিভেদ ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণেই তৈরি হয়। তবে সবাই যে ধর্ম ব্যবসায়ী—তা নয়। সমাজে আলোকিত, সৎ, নিষ্ঠাবান আলেম এখনো আছেন।
সচেতনতার অভাবেই মানুষ প্রতারিত হচ্ছেঃ
মানুষ ধর্ম ভালোবাসে। আর এই ভালোবাসাকে হাতিয়ার করে কিছু লোক সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়।
ধর্মচর্চার নামে ব্যবসা হতে পারে—এটি কেউ অস্বীকার করছে না।
কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে বাঁচতে হলে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে।
হক্কানি, সত্যবাদী, আলোকিত ধর্মগুরু বেছে নেওয়াই একমাত্র পথ।
ধর্ম চলমান থাকবে, ব্যবসাও—কিন্তু সঠিক পথ বেছে নেওয়া আমাদের দায়িত্ব
ধর্মের আলো কখনো নিভে যাবে না।
ধর্মের নামে ব্যবসাও চলবে—এটাই সমাজের বাস্তবতা।
কিন্তু সত্য দ্বীনের পথে থাকতে হলে আমাদের বিবেককে জাগ্রত রাখতে হবে।
ধর্মের নামে কৌশলী ব্যবসায়ীর ফাঁদে পড়া নয়; বরং সৎ, নৈতিক ও আল্লাহভীরু ব্যক্তির অনুসরণই আমাদের রক্ষা করবে।
ধর্ম পবিত্র, ধর্মের নামে ব্যবসা—এক বাস্তবতা, কিন্তু তা যেন মানুষের বিবেক, নৈতিকতা ও ঈমানকে প্রতারিত না করে।
দয়াময় আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য দ্বীনের পথে পরিচালিত করুন—এই প্রার্থনা রইল।
লেখক পরিচিতিঃ
মো. নুর ইসলাম মৃধা
গবেষক, কলামিস্ট ও সমাজ পর্যবেক্ষক
এমএ, এলএলবি, এলএইচএমপি
সমসাময়িক সামাজিক বাস্তবতা, ধর্ম-সংস্কৃতি ও মানবিক বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন।