
এস.এম.সাইফুল ইসলাম কবির
সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা নয়—এটি একটি দায়িত্ব, একটি সামাজিক অঙ্গীকার এবং অনেক সময় একটি আত্মত্যাগের নাম। সমাজের আয়না হিসেবে সাংবাদিকতা রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতা, সমাজ ও মানুষের সামনে সত্যকে তুলে ধরে। যে সমাজে সাংবাদিকতা শক্তিশালী, সে সমাজে গণতন্ত্র তুলনামূলকভাবে সুদৃঢ়; আর যেখানে সাংবাদিকতা দুর্বল, সেখানে সত্য চাপা পড়ে যায় ক্ষমতার ভারে।
কিন্তু এই সত্য প্রকাশের পথ কখনোই সহজ ছিল না। যুগে যুগে সাংবাদিকদের মোকাবিলা করতে হয়েছে ভয়, হুমকি, সেন্সরশিপ, দারিদ্র্য, নিপীড়ন এবং কখনো কখনো মৃত্যুকেও। আধুনিক ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তি সাংবাদিকতার গতি বাড়ালেও চ্যালেঞ্জ কমেনি—বরং তা আরও বহুমাত্রিক ও জটিল হয়ে উঠেছে।
এই প্রবন্ধে সাংবাদিকতার পেশাগত নানা চ্যালেঞ্জ, বাস্তবতা, সংকট এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
—
১. সত্য প্রকাশে চাপ, হুমকি ও জীবনঝুঁকি
সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সত্য। আর এই সত্যই সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। রাজনৈতিক দল, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান কিংবা অপরাধী চক্র—সবারই একটি সাধারণ চাওয়া থাকে: সংবাদ যেন তাদের অনুকূলে যায়।
সত্য প্রকাশ করলে অনেক সময় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয়—
মিথ্যা মামলা
গ্রেপ্তার ও হয়রানি
হুমকি ফোন ও বার্তা
সামাজিকভাবে হেয় করা
এমনকি শারীরিক হামলা ও হত্যাকাণ্ড
বিশ্বের বহু দেশে সাংবাদিক হত্যা এখনো বিচারহীন থেকে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল, মাদক সিন্ডিকেট, দুর্নীতি অনুসন্ধান বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্ট করতে গিয়ে সাংবাদিকরা সরাসরি মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েন।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করা মানে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তায় থাকা।
—
২. সেন্সরশিপ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা
সংবিধান অনেক দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও বাস্তবে সাংবাদিকরা নানা ধরনের সেন্সরশিপের মুখে পড়েন।
রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপ
সরকারের সমালোচনা, নিরাপত্তা বাহিনী, নির্বাচন, দুর্নীতি বা মানবাধিকার ইস্যুতে সংবাদ প্রকাশে অনেক সময় বাধা আসে। আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধি বা প্রশাসনিক চাপ সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে।
আত্ম-সেন্সরশিপ
সবচেয়ে ভয়ংকর সেন্সরশিপ হলো আত্ম-সেন্সরশিপ। চাকরি হারানোর ভয়, মামলা, বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক সাংবাদিক নিজেরাই সত্য লিখতে পিছিয়ে যান।
সামাজিক ও ধর্মীয় চাপ
ধর্মীয় মৌলবাদ, সামাজিক ট্যাবু বা সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগে আঘাত লাগতে পারে—এই আশঙ্কায় বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অপ্রকাশিত থেকে যায়।
—
৩. তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা ও ভুয়া খবরের মহামারী
ডিজিটাল যুগে তথ্যের প্রবাহ যেমন দ্রুত হয়েছে, তেমনি বেড়েছে ভুয়া খবর (Fake News), গুজব ও অপপ্রচার।
আজকের সাংবাদিকতার বড় চ্যালেঞ্জ হলো—
সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করা
সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য যাচাই
এআই-নির্ভর ভুয়া ভিডিও ও ছবি শনাক্ত করা
একটি ভুল তথ্য প্রকাশিত হলে শুধু একটি সংবাদমাধ্যম নয়, পুরো সাংবাদিক সমাজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে।
তাই এখন সাংবাদিক মানেই শুধু লেখক নয়—তিনি একজন ফ্যাক্ট-চেকার, গবেষক ও বিশ্লেষক।
—
৪. দ্রুততার চাপ ও ‘ব্রেকিং নিউজ’ সংস্কৃতি
বর্তমান সংবাদজগতে দ্রুততা একটি বড় প্রতিযোগিতা। কে আগে খবর দেবে—এই দৌড়ে অনেক সময় মান ও নৈতিকতা উপেক্ষিত হয়।
অসম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশ
যাচাই ছাড়া শিরোনাম
ক্লিকবেইট সাংবাদিকতা
এসব প্রবণতা পাঠকের আস্থা নষ্ট করে। একটি দায়িত্বশীল সংবাদ হয়তো পাঁচ মিনিট দেরিতে আসতে পারে, কিন্তু সেটি দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে।
—
৫. অর্থনৈতিক সংকট ও পেশাগত অনিশ্চয়তা
অনেক সাংবাদিক আজ চরম আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
কম বেতন
সময়মতো বেতন না পাওয়া
চাকরির নিরাপত্তাহীনতা
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের অনিয়মিত আয়
বিজ্ঞাপননির্ভর মিডিয়ায় কর্পোরেট স্বার্থ প্রভাব ফেলে সম্পাদকীয় নীতিতে। এতে স্বাধীন সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
একজন সাংবাদিক যখন ন্যূনতম জীবনযাপন নিশ্চিত করতে পারেন না, তখন তার কাছ থেকে সাহসী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
—
৬. ডিজিটাল যুগের প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ
আজকের সাংবাদিককে একাধারে হতে হয়—
লেখক
ভিডিওগ্রাফার
ভিডিও এডিটর
সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার
ডেটা বিশ্লেষক
এর পাশাপাশি রয়েছে—
সাইবার হ্যাকিং
ডক্সিং (ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস)
অনলাইন ট্রোলিং ও হেট স্পিচ
বিশেষ করে নারী সাংবাদিকরা ডিজিটাল সহিংসতার শিকার হন বেশি।
—
৭. মানসিক চাপ, ট্রমা ও বার্নআউট
দুর্যোগ, যুদ্ধ, ধর্ষণ, হত্যা, লাশ, কান্না—এসব দৃশ্য নিয়মিত কভার করতে গিয়ে সাংবাদিকরা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েন।
কিন্তু সমাজ খুব কমই তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভাবে।
দীর্ঘ কর্মঘণ্টা
পরিবার থেকে দূরে থাকা
নিরাপত্তাহীনতা
সামাজিক চাপ
এসব মিলিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ ও বার্নআউট ক্রমেই বাড়ছে।
—
৮. নৈতিকতা ও আদর্শ রক্ষার সংগ্রাম
সাংবাদিকতার প্রাণ হলো নৈতিকতা। কিন্তু বাস্তবতার চাপে অনেক সময় এই নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
উপহার বা সুবিধা গ্রহণ
পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ
রাজনৈতিক লাইন অনুসরণ
তবুও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—সব যুগেই কিছু সাংবাদিক ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন—যারা মাথা নত করেননি।
—
৯. সাংবাদিকতা কেন এখনো গুরুত্বপূর্ণ
সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সাংবাদিকতা আজও অপরিহার্য—
দুর্নীতি প্রকাশ
ক্ষমতার জবাবদিহি
প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর
গণতন্ত্রের পাহারাদার
একজন সৎ সাংবাদিক সমাজকে প্রশ্ন করতে শেখায়, অন্ধ অনুসরণ থেকে মুক্ত করে।
—
উপসংহার
সাংবাদিকতা সহজ কোনো পেশা নয়। এটি সাহসীদের পথ। এখানে নেই নিশ্চিত নিরাপত্তা, নেই বিপুল সম্পদের নিশ্চয়তা। কিন্তু আছে ইতিহাস বদলে দেওয়ার ক্ষমতা।
সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো মানে একা দাঁড়ানো। তবুও সাংবাদিকতা বেঁচে থাকবে—কারণ সমাজের অন্ধকার যত গভীর হয়, আলো ততই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।
চ্যালেঞ্জ অনেক, ঝুঁকি আরও বেশি—তবু সাংবাদিকতার ভূমিকা অপরিসীম, অনিবার্য এবং অবিচ্ছেদ্য।
এস.এম.সাইফুল কবির চেয়ারম্যান জাতীয় মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি ঢাকা।
মোবাইল 01711377450
smsaifulpress24@gmail.com