এস.এম,সাইফুল ইসলাম কবির:
বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতের বাইরে, প্রান্তিক জনপদের নীরব অথচ গভীর সাহিত্যচর্চার যে ধারাটি অব্যাহতভাবে প্রবাহিত হচ্ছে—কবি মোঃ জাবেদুল ইসলাম তার এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি। তিনি এমন একজন কবি ও কথাসাহিত্যিক, যাঁর লেখার ভেতর দিয়ে কথা বলে নদী, চর, গ্রামবাংলা, সংগ্রামী মানুষ, শিশুদের স্বপ্ন আর মুক্তিযুদ্ধের অমলিন স্মৃতি। তাঁর সাহিত্য কোনো বিলাসী কল্পনার ফসল নয়; এটি জীবনের ভেতর থেকে উঠে আসা বাস্তব অভিজ্ঞতার শিল্পিত রূপ।
---
জন্ম, শেকড় ও উত্তরবঙ্গের প্রভাব
কবি মোঃ জাবেদুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১২ই জুন ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে, লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সাবেক বড়খাতা ইউনিয়নের দালালপাড়া গ্রামে। এই অঞ্চল তিস্তা নদী দ্বারা প্রভাবিত—কখনো শান্ত, কখনো ভয়ংকর। নদীভাঙন, দারিদ্র্য, সংগ্রাম আর মানুষের টিকে থাকার লড়াই এই জনপদের নিত্যসঙ্গী। এই বাস্তবতা তাঁর শৈশব ও কৈশোরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, যা পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্যকর্মে বারবার ফিরে এসেছে।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতা শমসের আলী ছিলেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন নিষ্ঠাবান কর্মচারী। তিনি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগে যোগদান করেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ডাকে সাড়া দিয়ে, বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা পিতার সাহস, ত্যাগ ও দেশপ্রেম কবি মোঃ জাবেদুল ইসলামের জীবনদর্শনে গভীর ছাপ ফেলে। তাঁর কবিতা ও গল্পে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নৈতিক দৃঢ়তা ও দেশপ্রেমের প্রকাশ দেখা যায়—তা মূলত এই পারিবারিক উত্তরাধিকারেরই ফল।
---
পারিবারিক জীবন ও বর্তমান বসবাস
কবি মোঃ জাবেদুল ইসলাম বর্তমানে একজন পারিবারিক মানুষ। তাঁর স্ত্রী মোছাঃ উম্মে কুলসুম খন্দকার। তাঁদের সংসারে দুই পুত্র ও এক কন্যা রয়েছে। পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যাওয়াই তাঁর জীবনের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য।
বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন—
গ্রাম: রমনীগঞ্জ
ডাকঘর: বড়খাতা
উপজেলা: হাতীবান্ধা
জেলা: লালমনিরহাট
এই গ্রামীণ পরিবেশই তাঁকে আজও সাহিত্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত করে রেখেছে। শহুরে কোলাহল থেকে দূরে থেকেও তিনি শব্দের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছেন পাঠকের হৃদয়ে।
---
শিক্ষাজীবন ও সাহিত্যচর্চার শুরু
ছাত্রজীবন থেকেই কবি মোঃ জাবেদুল ইসলামের লেখালেখির প্রতি গভীর অনুরাগ গড়ে ওঠে। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত কবিতা ও গল্প লিখতেন। স্কুল–কলেজ জীবনেই স্থানীয় পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রকাশ পেতে শুরু করে।
এই সময় থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন—লেখালেখি তাঁর শখ নয়, তাঁর দায়; তাঁর নিজের এলাকার মানুষের কথা বলার একমাত্র শক্তিশালী মাধ্যম।
---
সাহিত্যভাবনা ও লেখার দর্শন
কবি মোঃ জাবেদুল ইসলামের সাহিত্যভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানুষ। বিশেষ করে প্রান্তিক, অবহেলিত ও সংগ্রামী মানুষ। তাঁর কবিতায় যেমন উঠে আসে একটি পতাকা, একটি দেশের কথা—তেমনি গল্পে উঠে আসে তিস্তা পাড়ের মেয়ের জীবনসংগ্রাম, নদীভাঙা মানুষের বেদনা, শিশুদের কল্পনার জগৎ ও নৈতিক শিক্ষার গল্প।
তিনি বিশ্বাস মনে করেন—
> “সাহিত্য মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ভাষা।”
এই বিশ্বাস থেকেই তাঁর গল্পে পাওয়া যায় সততা, মানবিকতা, দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার শক্ত বার্তা।
---
কাব্যগ্রন্থ ও কবিতার অবদান
একক কাব্যগ্রন্থ
একটি পতাকা একটি দেশ
এই কাব্যগ্রন্থে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয় পরিচয় ও মানুষের আত্মত্যাগ গভীর আবেগে ফুটে উঠেছে।
যৌথ কাব্যগ্রন্থ
স্মৃতির পাতায় কবিতা
কাব্যাঞ্জলি
কাব্য সুধা
শতকাব্য
কবিদের কবিতা–৩
সাহিত্যের আলো
প্রভৃতি
এই যৌথ কাব্যগ্রন্থগুলোতে তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে সহজভাবে পৌঁছেছে এবং সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।
---
গল্পকার হিসেবে পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য গল্প
কবি মোঃ জাবেদুল ইসলাম একজন শক্তিশালী কথাসাহিত্যিকও বটে। তাঁর গল্পগুলোতে গ্রামীণ বাস্তবতা, শিশুদের কল্পনাজগৎ, মুক্তিযুদ্ধ ও সামাজিক শিক্ষার মেলবন্ধন দেখা যায়।
উল্লেখযোগ্য গল্পসমূহ
তিস্তা পাড়ের মেয়ে
কালো মেয়ে
তিস্তার মানুষের জীবন সংগ্রাম
মাটির ব্যাংক সততার পরিচয়
মুক্তিযুদ্ধের সেই গল্প
ভালো মা
তিন শালিকের গল্প
খুকু ও নীলপরী
ভুতের শক্তি
আরও বহু পাঠকপ্রিয় গল্প
বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা গল্পগুলো নৈতিক শিক্ষা ও কল্পনার শক্তিতে ভরপুর।
---
পত্রিকায় প্রকাশ ও সাহিত্যাঙ্গনে অবস্থান
কবি মোঃ জাবেদুল ইসলামের কবিতা ও গল্প দেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যচর্চা তাঁকে একজন পরিশ্রমী, বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
---
উপসংহার
কবি মোঃ জাবেদুল ইসলাম এমন একজন সাহিত্যিক, যিনি শব্দকে ব্যবহার করেন মানুষের পক্ষে কথা বলার জন্য। তাঁর সাহিত্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বাংলা সাহিত্য শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়; গ্রাম, নদী, চর আর প্রান্তিক মানুষের জীবনও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নীরবে, নিভৃতে, অবিরাম লেখালেখির মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তাঁর কলম আরও দীর্ঘদিন মানুষের কথা বলুক—এই প্রত্যাশাই সাহিত্যপ্রেমীদের।