সবুজের জীবন দেখতে গেলে বেশ স্বাভাবিকই বলা যায়।
চাকরি আছে—মধ্যম মানের এক সরকারি অফিসে কর্মরত।
পরিবারে মা-বাবা,ভাই, স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে।
সব মিলিয়ে বাইরের চোখে সংসার মোটামুটি গুছিয়ে আছে।
কিন্তু সমস্যা হলো—সবুজের মনের ভেতরের চাহিদা।
যা তার প্রয়োজনের থেকেও অনেক বেশি, অনেক দূরে।
সে সবসময় চায়, সমাজে তার নাম থাকবে আলাদা মর্যাদায়।
সবাই তাকে গুরুত্ব দেবে, তার মতামত শুনবে, মাথা নত করবে।
যদিও বাস্তবে তা হয় না।
পাড়ার মিটিং হলে তার কথায় খুব কম লোকই সাড়া দেয়।
আত্মীয়-স্বজনের আড্ডায় তাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
সবুজ মনে মনে ভাবতে থাকে—
“আমি তো সবার ভালো চাই, সবার পাশে দাঁড়াই,
তবুও কেন আমার কথা মানুষ শুনবে না?”
ধীরে ধীরে সে এই বিষয়টিকে অহংকারের প্রশ্নে পরিণত করে ফেলল।
সে বুঝতেই পারল না—যে সম্মান আর মর্যাদা সে চায়,
তা কখনোই দাবি করে পাওয়া যায় না,
বরং সেটা মানুষের হৃদয়ে নিজের আচরণের মাধ্যমেই তৈরি হয়।
একদিন এক আত্মীয়ের বাড়িতে পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে যায় সবুজ।
বড়দের মাঝে বসে কথা বলছিল।
হঠাৎ অনুষ্ঠান বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা আলোচিত হতে থাকে।
সবুজ তার মতামত দিতে শুরু করল—
“আমার মতে এমন না তেমনভাবে করা উচিত…”কিন্তু একজন অভিজ্ঞ কাকা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“দেখো, আমরা এটা আগেই ঠিক করেছি। তুমি এখন চুপ থাকো।”
এই কথায় সবুজের মনে আগুন জ্বলে উঠল।
মুখে কিছু না বললেও মন ভরে গেল ক্ষোভে।
তারপর থেকে সে ভেতরে ভেতরে ভাবতে লাগল—
“আমাকে তারা পাত্তা দেয় না, আমার কথা গুরুত্ব পায় না।”
সেদিন রাতেই সবুজ নিজের ঘরে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে ভাবছিল—
“আমার মতামতের গুরুত্বই যদি না থাকে, তবে আমি কেন থাকব তাদের সাথে?
আমার কি কোনো দামই নেই?”
কিন্তু সে একবারও ভাবল না—
সে যে বিষয়টা নিয়ে জেদ করছে, সেটি আসলে তার প্রয়োজন কি না।
সে ভুলে গেল—
"সব পাত্রে পরিষ্কার জল ধারণ করা যায় না,
আর সব পাত্রে জল পানও করা যায় না,
যতই তা পরিষ্কার হোক না কেনো"!
এরপর থেকে সবুজ নানা অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করে দিল।
পাড়ার মিটিং, আত্মীয়দের সাথে দেখা—সব কিছুতে দূরত্ব তৈরি করল।
সে মনে করল, এভাবে সবাই বুঝবে,
তার অভাব তাদের জন্য কষ্টের হবে।
কিন্তু ফল হলো উল্টো।
মানুষ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেল তার অনুপস্থিতিতে।
যারা আগে মাঝে মাঝে খোঁজ নিত, তারাও চুপ হয়ে গেল।
সবুজ তখন বুঝল—
যে গুরুত্ব সে পেতে চাইছিল,
সে নিজেই তার থেকে সরে যাচ্ছে।
একদিন তার স্ত্রী বলল—
“শোনো, তুমি যত দিন ধরে এভাবে একা হয়ে আছো,
তোমার মনও বদলে যাচ্ছে।
তুমি ছোট বিষয়কে বড় করে দেখছো।
যে মানুষ তোমার সাথে কথা বলে না,
সে হয়তো নিজের সমস্যায় ডুবে আছে,
তোমাকে ছোট করার জন্য নয়।”
সবুজ তখনও জেদ ধরে বলল—
“না, আমি জানি তারা আমাকে পাত্তা দেয় না।
আমি তাদের দেখিয়ে দেব।”
স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—
“তুমি আসলে নিজের কষ্ট নিজেই তৈরি করছো।
নিজের সুখের চাবি অন্যের হাতে দিয়ে দিয়েছো।
যেদিন তুমি বুঝবে, সুখ তোমার নিজের ভেতরেই,
সেদিন এই কষ্ট শেষ হয়ে যাবে।”
মাসখানেক পর, এক আত্মীয় মারা গেলেন।
সবুজ গেল না শেষকৃত্যে।
কারণ—সে এখনো অভিমানী।
কিন্তু পরে শুনল, সেই আত্মীয় জীবনের শেষ দিকে প্রায়ই বলতেন—
“সবুজের সাথে দেখা হয় না, ও কেন এত দূরে সরে গেল বুঝি না।”
এই কথা শুনে সবুজের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল।
সে বুঝতে পারল—
যে মানুষটার জন্য সে কষ্ট পাচ্ছিল,
যাকে সে শত্রু ভেবেছিল,
সে মানুষটা আসলে তাকে মিস করত।
সবুজের মনে তখন একটাই কথা বাজল—
"আমরা নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রু।"
যতদিন আমরা নিজের ভেতরের অহংকার, অকারণ আশা,
আর অতিরিক্ত চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারব,
ততদিন কষ্টের শেষ হবে না।
আসলে- যখন মানুষ আত্মবিচার করতে শেখে, তখন সে শুধু নিজের জীবন নয়, পরিবারেরও জীবন বদলে দিতে পারে।
সবুজ বুঝে গেল—
"সুখ বাইরের কিছু নয়—এটা নিজের ভিতরেই জন্মায়, আর সেই সুখের আলো সবচেয়ে আগে পৌঁছানো উচিত নিজ মন কুটিরে"
সে সেদিনই সিদ্ধান্ত নিল—
অন্যের স্বীকৃতির জন্য নয়,
নিজের বিবেকের শান্তির জন্য বাঁচবে।
যে সম্পর্কগুলো এখনো টিকে আছে,
তাদের সাথে সময় কাটাবে, ভালোবাসা দেবে,
আর ভুল পথের দীর্ঘ যাত্রা থেকে ফিরে আসবে।
প্রকৃতপক্ষে-
"তুমি নিজের সুখের চাবি অন্যের হাতে দিলে মানে,
তুমি নিজের কারাগারের তালা নিজেই বন্ধ করে দিলে।"
এইজন্য-
"ভুল পথের বিচরণ যত দীর্ঘ হবে,
ফেরার পথ ততই কঠিন হবে।"