
ছাতক (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি:
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় লন্ডন প্রবাসী কথিত পীর গিয়াস উদ্দিন তালুকদারের বিরুদ্ধে পবিত্র মক্কা-মদিনা ও মসজিদের অবমাননার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
তার একটি সাম্প্রতিক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘গিয়াস উদ্দিন তালুকদার দরবার শরীফ’-কে পবিত্র মক্কা-মদিনা ও মসজিদের সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছেন, যা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ছাতক উপজেলার ভাতগাঁও ইউনিয়নের শক্তিয়ারগাঁও গ্রামে অবস্থিত ওই দরবার শরীফকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরেই নানা বিতর্ক চলছিল। তবে সম্প্রতি কথিত পীরের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে।
অভিযোগকারীদের দাবি, বক্তব্যে তিনি বলেছেন— মক্কা-মদিনা ও মসজিদে গিয়ে যে পরিমাণ সওয়াব ও নেকি অর্জিত হয়, তার দরবার শরীফে গেলেও নাকি একই পরিমাণ সওয়াব পাওয়া যাবে। এ ধরনের বক্তব্যকে তারা ‘ধর্মীয় বিভ্রান্তি’ ও ‘পবিত্র স্থান সমূহের অবমাননা’ হিসেবে দেখছেন।
এ ঘটনায় কথিত পীরের ছোট ভাই ইসলাম উদ্দিনসহ স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মানুষজন গত ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, গিয়াস উদ্দিন তালুকদার দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পীর হিসেবে প্রচার করে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে অর্থ আদায় করে আসছেন।
অভিযোগকারীদের ভাষ্য অনুযায়ী, তার বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড ইসলামের মৌলিক আকিদা ও শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অভিযোগের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে পবিত্র মদিনা শরীফ অবমাননার প্রসঙ্গ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, কথিত পীর ভক্তদের সামনে নিজের শারীরিক অবস্থার সঙ্গে পবিত্র মদিনা শরীফের তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। এই বক্তব্যকে তারা ‘অত্যন্ত আপত্তিকর, বিভ্রান্তিকর ও হৃদয়বিদারক’ বলে আখ্যা দেন। অভিযোগকারী ইসলাম উদ্দিন বলেন, “পবিত্র মদিনা শরীফের সঙ্গে কোনো মানুষের শরীরের তুলনা করা মারাত্মক ধর্মীয় অবমাননার শামিল। এর মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আবেগকে ব্যবহার করে বাণিজ্যিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, দরবার শরীফে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়, যা ইসলামী অনুশাসনের পরিপন্থী। কথিত পীর ও তার স্ত্রী মাহিমা বেগমের বিরুদ্ধে অশ্লীল কার্যকলাপ, মদ ও গাঁজা সেবনসহ নানা কুরুচিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগও আনা হয়েছে। অভিযোগকারীদের দাবি, এসব কর্মকাণ্ড ইচ্ছাকৃতভাবে পরিচালিত হয় ভক্তদের আকৃষ্ট করার কৌশল হিসেবে।
লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, দরবার শরীফে নিয়মিতভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান সামগ্রী ‘নজরানা’ হিসেবে আদায় করা হচ্ছে। পরে এসব অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগকারী ইসলাম উদ্দিন বলেন, “এই দরবারটি মূলত একটি বাণিজ্যিক প্রতারণা কেন্দ্র। ধর্মীয় আবরণে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে তা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এর ফলে অনেক পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
অভিযোগকারীদের মতে, এই দরবারের কার্যক্রম সামাজিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এলাকার একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দরবার শরীফে নিয়মিত যাতায়াতের ফলে অনেক মানুষ পারিবারিক কলহ, আর্থিক সংকট ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ দাবি করেছেন, দরবারের বিরোধিতা করায় তাদের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
এলাকাবাসীর একটি অংশ মনে করছেন, এই ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা অবিলম্বে দরবার শরীফের কার্যক্রম বন্ধ করে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
অভিযোগপত্রে এলাকার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও ধর্মপ্রাণ মানুষের নাম সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই অভিযোগের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অভিযোগকারীরা বলেন, আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। তারা বলেন, লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বাস দেন তারা।
অন্যদিকে, অভিযোগের বিষয়ে কথিত পীর গিয়াস উদ্দিন তালুকদারের বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে এ বিষয়ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, ছাতকসহ সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বিভিন্ন দরবার ও কথিত পীরকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এর আগেও নানা বিতর্ক ও অভিযোগ উঠেছে। সচেতন মহল মনে করছেন, ধর্মীয় বিশ্বাসের নামে প্রতারণা ও বিভ্রান্তি রোধে প্রশাসনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও জরুরি। বর্তমান অভিযোগের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটিত হলে তা ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেছেন।