
কলমে: ইরি অতনু
সেদিনটা ছিল অদ্ভুত নীরব। সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছিল নিজেকে, জানালার কাঁচে জমে থাকা ধুলোয় সূর্যের শেষ রঙটুকু আটকে ছিল। আমি একা ছিলাম—শুধু ঘরে নয়, ভেতরেও। এমন এক একাকীত্ব, যার শব্দ নেই, অথচ উপস্থিতি ভারী।
ঠিক তখনই তুমি এলে।
কোনো আগাম ইঙ্গিত ছিল না। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দও নয়। শুধু হঠাৎ করে, যেন বাতাসের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে এসে তুমি বললে,
— “তোমার নামটা কী?”
কণ্ঠে ছিল মধুরতা, কিন্তু তাতে কোনো দাবি ছিল না। প্রশ্নটা শুনে মনে হলো, বহুদিন পর কেউ আমাকে সত্যিই দেখতে চাইছে। নাম বললাম। তারপর কথারা নিজস্ব গতিতে হাঁটতে শুরু করল—কোথাও থামল না, কোথাও ছুটল না। সময়ও যেন একটু ধীর হয়ে গেল।
তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুঝলাম, তুমি আলাদা। অকারণ প্রশ্ন করো না, আবার প্রয়োজনের কথাও এড়িয়ে যাও না। ধীরে ধীরে তুমি এমন এক অভ্যাস হয়ে উঠলে, যা আমার অজান্তেই দিনে কয়েকবার ফিরে আসে। চায়ের কাপে, জানালার ফাঁকে, রাতের নির্জনতায়।
তবু একটা রেখা ছিল—দূরত্বের রেখা। তুমি সেটা টেনে রাখলে যত্ন করে। কাছে থেকেও দূরে। হঠাৎ একদিন তুমি থামিয়ে দিলে কথা বলার সেই স্বাভাবিক ধরণ। আগের মতো হাসি নেই, আগের মতো প্রশ্ন নেই। আমি টের পেলাম, কিন্তু কিছু বললাম না। কারণ কিছু প্রশ্ন আছে, যেগুলো উচ্চারণ করলে উত্তর পাওয়া যায় না—শুধু সম্পর্কের ভারসাম্য নড়ে যায়।
আমি শুধু জানতে পারলাম না—তোমার আগমন মানে কী?
তুমি কি এসেছিলে একাকীত্ব ভাঙাতে, নাকি একে আরও স্পষ্ট করে দেখাতে? তুমি কি ছিলে সাময়িক আশ্রয়, নাকি স্থায়ী কোনো শূন্যতার ইঙ্গিত? এই প্রশ্নটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, ভিড়ের মাঝেও, এমনকি ঘুমের মধ্যেও।
একদিন তুমি আবার এলে। আগের মতো হঠাৎই। কিছু বললে না। শুধু চুপচাপ বসে থাকলে। তখন বুঝলাম—সব আগমনের মানে শব্দে ধরা পড়ে না। কিছু মানুষ আসে আমাদের জীবনে আয়নার মতো। তারা থাকে অল্প সময়, কিন্তু দেখিয়ে যায়—আমরা কতটা একা, কতটা অপেক্ষমাণ।
তোমার আগমন মানে তাই কোনো প্রতিশ্রুতি নয়। কোনো নিশ্চয়তাও নয়। তোমার আগমন মানে ছিল—আমাকে আমার ভেতরের নীরবতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
আর তুমি চলে যাওয়ার পর, আমি জানলাম—কিছু আগমন আসে, শুধু তাড়িয়ে বেড়ানোর জন্য নয়, বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।