বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ, বৈশাখের ১ তারিখ, তথা বাংলা নববর্ষ। এই দিনটি সকল বাঙালি জাতির এতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এবং প্রবাসী বাঙালিদের জন্য আনন্দমূখর মিলন মেলার দিন।
বাংলা সনের প্রবর্তক নিয়ে সম্রাট আকবর বেশী আলোচিত হলেও বাংলা পঞ্জির উদ্ভাবক ধরা হয় ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্ককে। পরবর্তীতে সম্রাট আকবর রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে সেটিকে পরিবর্তন করেন। ইংরেজি সালের সাথে বাঙালিরা খাজনা দিতে পারতো না, অহেতুক পাইক-পেয়াদার নির্যাতনের শিকার হতো।কৃষকদের সুবিধার কথা চিন্তা করে সম্রাট আকবর তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ” ফতেহ উল্লাহ সিরাজি”কে আদেশ করেন হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে বাংলা সনের নিয়ম তৈরী করতে।
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে প্রথম বাংলা সন গণনা করা হয়। তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে খাজনা আদায়ে এই গণনা কার্যকর শুরু হয়েছিল ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। পূর্বে ফসল কাটা ও খাজনা আদায়ের জন্য এই বছরের নাম দেওয়া হয়েছিল ফসলি সন।পরে তা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন করা হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে কৃষকদের খাজনা বা শুল্ক দিতে হতো। তখন থেকেই সম্রাট আকবর কৃষকদের জন্য মিষ্টি ও সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। হালখাতার প্রচলনও তখন থেকেই ছিলো। আজও দেখা যায় ব্যবসায়ীদের হালখাতার পসরা বসাতে।
বর্তমান বাংলা সন এসেছে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাদেশ এই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল উদযাপন করে আসছে। উল্লেখ যে, ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে আয়োজিত যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে, সেটিকে ” মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ” হিসেবে ঘোষনা করে।
পহেলা বৈশাখ আমাদের একটা ঐতিহ্য গত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এর মর্মে মর্মে গাঁথা আছে বাঙালি ঐতিহ্য, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের বিভিন্ন লেখায় বাঙালির অসম্প্রদায়িক দিকটা চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। এ দিনে বাংলাদেশ, ভারত ও প্রবাসি বাঙালির মধ্যে নব প্রাণ সঞ্চারিত হয়।বাংলা নববর্ষের এ ঐতিহ্য মাটি ও মানুষের সংগে ওতোপ্রোতো ভাবেই জড়িত। এখানে কোনো জাতিভেদ ও ধর্মভেদ নেই। এ উৎসবে ঢাকা ও কলকাতার পাশাপাশি প্রবাসি ও শহর- গ্রামে তরুন-তরুনী যুবক-যুবতী সহ আবাল বৃদ্ধ বনিতা মেতে ওঠেন। সবার কণ্ঠে অনুরণিত হয় রবীন্দ্রনাথের এই গানটি— ” এসো হে বৈশাখ, এসো এসো / তাপস নিঃশ্বাস বায়ে,মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা/ যাক মুছে যাক।
রবীন্দ্রনাথ নজরুল থেকে হালের কবি সাহিত্যিকরাও বৈশাখ নিয়ে গান কবিতা সাহিত্য রচনা করেছেন। নজরুল বলেছেন, ধ্বংস আর যুদ্ধ থেকেই নতুনের সৃষ্টি হয়।তেমনি বাংলা নববর্ষের কালবৈশাখী ঝড় বা রুদ্র রূপ থেকেই অনুপ্রেরণা পায় বাঙালি। ”
আবার সমুদ্র গুপ্তের বৈশাখ:একাত্তরে, কবিতায় স্মৃতিচারণ পাই; মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও ব্যঞ্জনা, যুদ্ধাবস্থার কথা পাই -, যুদ্ধের প্রথম মাসে এসেছিলো ১লা বৈশাখ। মেঘের ডম্বরু ফেলে হাতে হাতে উঠেছিল / স্বাধীনতা যুদ্ধের বজ্রনিনাদ/ যুদ্ধমূখী পা আর স্বাধীনতা দেখে ফেলা চোখ / আমাদের জেগে ওঠার/ প্রথম সাক্ষী ছিলো বৈশাখী মেঘ।
৪৭ দেশ বিভাগ, ৫২ ভাষা আন্দোলন, ৫৪ যুক্তফ্রণ্ট ৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯ গণ অভুত্থান,৭০ সাধারণ নির্বাচন ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, তাকে জানাই অজস্র শ্রদ্ধা ও সালাম। একটি অনুষ্ঠান বা সংস্কৃতি তখনই পূর্ণতা পায় যখন স্বাধীনতা থাকে, মনে শান্তি থাকে। হ্যা বন্ধুগণ, সেকথাই বলছি।স্বাধীনতার পর থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে স্বচ্ছতা ও সৌন্দর্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সৌন্দর্য ও মন খোলা সংস্কৃতি বজায় থাক আজীবন, বাড়ুক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি। সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।