লেখকঃ সাকিব মাহমুদ
ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের ক্ষতি করে এমন সকল-কিছুকে ইসলাম হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর সকল মানুষের জন্য উত্তম এবং উপকারী এমন সকল বিষয়কে করেছে হালাল ও বৈধ। আল্লাহ তা’য়ালা সুরা আরাফের ১৫৭ নং আয়াতে বলেন, অর্থাৎ ” তিনি তাদের জন্য উৎকৃষ্ট বস্তু হালাল করবে ও নিকৃষ্ট বস্তু হারাম করবে।”
প্রকৃতপক্ষে মানুষের অন্তর বা নফস সর্বদা তার চাহিদাগুলো চরিতার্থ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু পরিণামে যে বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় সেদিকে সে খেয়ালই করতে চায়না। এ কারণে ইসলাম তার অনুসারীদের নফসের খামখেয়ালি ও একগুয়েমীর লাগাম টেনে ধরার নির্দেশ প্রদান করেছে। মানুষ যত ধরনের সমস্যা ও ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে, সেগুলো থেকে বাচিয়ে রাখার জন্য প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক নানা আইন ও বিধান প্রনয়ণ করেছে। মানুষের জন্য অনিষ্টকর এমন সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি সমস্যা হচ্ছে মাদকাসক্তি। প্রাচীন আরবদের মাঝে এটি রক্তমাংসের সাথে মিশে গিয়েছিল, কবিদের কবিতায়, ঘরে-বাইরে, সভা-সমাবেশে কোনো স্হানেই মদ ছাড়া চলত না। এ কারণে এই সমস্যার প্রতিকারে আল্লাহ প্রদত্ত সমাধানও এসেছে অতি বিচক্ষণ পদ্ধতিতে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “অর্থাৎ (হে নবী!) তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, আপনি বলে দিন তাতে রয়েছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য কিছু উপকার। কিন্তু এ দুটির উপকারের থেকে তার পাপ গুরুতর।”(সুরা বাকারা, ২১৯ নং আয়াত)
এ আয়াত থেকে বুঝা গেল মদ ও জুয়াতে বড় গুনাহ আছে। তাহলে এ ব্যাপারে চুড়ান্ত বিধান কী? হযরত ওমর রা. দুআ করলেন,”হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য মদের ব্যাপারে একেবারে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করুন।”( মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৩৭৮)
তখন আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্ট বিধান জানিয়ে বললেন, “হে মু’মিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া,প্রতিমার বেদি ও জুয়ার তীর এসব অপবিত্র ও শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা এসব পরিহার করো, যেন তোমরা সফল হতে পারো।”-(সুরা মায়িদা,৯০ নং আয়াত) এ আয়াত থেকে বুঝা গেল যে, মাদকদ্রব্য হতে বেঁচে থাকার মধ্যেই রয়েছে সফলতা।
রাসুল সা: মাদকদ্রব্য সেবনের ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক ক্ষতি বর্ণনা করে ও দন্ডবিধি প্রয়োগের মাধ্যমে মাদক প্রতিকারের চেষ্টা করেছেন।
(১)প্রার্থিব ক্ষতি।
হযরত আবূ দারদা রা. বলেন, একবার এক লোক রাসুল সা: এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে কিছু নসিহত করুন। নবিজী তাকে বললেন, ” আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না এবং মদ পান করো না। কেননা এটা সকল অন্যায়ের চাবিস্বরুপ।”( ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৪০৩৪)
এছাড়া মানুষের স্বাস্হ্যের উপর ক্ষতিকারক প্রভাবের কথাও রাসুল সা: গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। একবার এক সাহাবি রাসুলের নিকট এসে মদকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি চেয়েছিলেন। রাসুল সা: তাঁকে বললেন, ” নিশ্চয়ই এই মদ ব্যাধি, ব্যাধিনিরোধক নয়।( সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ২০৬৫)
আজকের আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রও প্রমাণ করেছে, যারা মদপানে অভ্যস্ত, তারা খুব সহজেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যেমন লিভার ব্লক হয়ে যাওয়া। এর কারণ হলো মদ ফেনসিডিল। লিভারের দেহকোষকে ধ্বংস করে ফেলে সেখানে চর্বি জমায়। এ ছাড়া মদের কারণে পরিপাকতন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও দুরবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন মানুষ তার স্বাভাবিক খাদ্য চাহিদা হারিয়ে ফেলে। পুষ্টিহীনতা ও ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয়। হার্টের মাংসপেশিতেও খারাপ প্রভাব ফেলে এবং রক্তগঠনের বিভিন্ন উপাদানেও সমস্যা দেখা দেয়। [ www.alriyadh.com]
(২) দ্বিতীয় পদ্ধতি তথা পারলৌকিক ক্ষতির বর্ণনা ।
রাসুল সা: বলেছেন, তিনজন ব্যক্তির উপরে আল্লাহ জান্নাতকে হারাম করেছেন। তাঁরা হলো: মদ পানকারী,মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান ও দাইয়ুস।( মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ৫৩৭২)
কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর।
১. শুধুই কি মদপান কারী অপরাধী?
উত্তরঃ এ বিষয়ে রাসুল সা: বলেছেন, “মদ, মদ পানকারী ও তা পরিবেশনকারী ও তা বিক্রেতা ও তার ক্রেতা এবং তার উৎপাদক এবং যে উৎপাদন করায় এবং তা সরবরাহকারী এবং যার জন্য সরবরাহ করা হয়, এদের সকলকে আল্লাহ অভিশাপ দেন। ( সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ১২৯৫)
২. ইসলাম কি শুধুমাত্র মদকেই হারাম করেছে? এবং অন্যান্য তরল বা পানীয় মাদকের হুকুম কী?
উত্তর: হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসুল সা: বলেছেন, “যে পানীয়ই মাদকতা বা নেশা সৃষ্টি করে তা হারাম।( সহিহ মুসলিম, হাদিস নং (২০০১)
৩. আরো প্রশ্ন থাকতে পারে যে, তরল মাদকদ্রব্যের হুকুম জানা গেল, তাহলে ইয়াবা, গাঁজা, ভাং, চুরুট, হিরোইন এগুলোর ব্যাপারে ইসলাম কী বলে?
উত্তর: হযরত উম্মে সালামা রা. বলেন, রাসুল সা: সকল নেশাদায়ক ও অবসাদ সৃষ্টিকারী সকল প্রকার দ্রব্য থেকে নিষেধ করেছেন। ( মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ২৬৬৭৬)
(৩) তৃতীয় পদ্ধতি তথা দন্ডবিধি প্রয়োগের মাধ্যমে।
রাসুল সা: অবাধ্য ও মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের জন্য শাস্তির সকল দন্ডবিধানই প্রয়োগ করেছেন। যেমন হযরত কাবিসা ইবনে জুআইব রা. বলেন, রাসুল সা: বলেছেন,” যে ব্যক্তি মদপান করে, তাকে তোমরা বেত্রাঘাত করো। ( সুনানে নাসাঈ, হাদিস নং ৫৬৬১)
হাঁ এভাবেই রাসুল সা: কার্যকরভাবে পর্যায়ক্রমে মাদক ও নেশার সমস্যা সমাধান করেছেন। আমাদের সমসাময়িক বিশ্বে আধুনিক সমাজেও এই সমস্যা ভীষণ আকার ধারণ ছড়িয়ে পড়েছে। পুরো বিশ্ব এখন এই ভয়াবহ সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত ও জর্জরিত। বলাবাহুল্য কত তীব্রভাবেই-না বিশ্ব আজ মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে কুরআন ও হাদিসের সেই নিয়ম ও পদ্ধতির দিকে মুখাপেক্ষী হয়ে আছে। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। মাদক থেকে দূরে থাকার এবং মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখার জন্য কবূল করুন।( আমীন)