কলমেঃ সাহেলা সার্মিন
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
অথবা,
“মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু মুসলমান,
মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।”
বাংলা সাহিত্য জগতে এমন মানবতার জয়গান আর কারো কলমে উঠে আসেনি।আর কারো কোমল হৃদয় সকল জাতির জন্য সমভাবে ব্যথিত হয়নি। তাইতো তিনি মানবতার কবি, তিনি সাম্যবাদের কবি। তিনি ছিলেন একাধারে শ্রমিক, সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক।
নজরুল ১৮৯৯ সালের ২৪ শে মে, বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ ই জ্যৈষ্ঠ পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার, আসানসোল মহকুমার, চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহম্মেদ ও মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। বাল্য কালে তিনি দুখু মিয়া নামেই পরিচিত ছিলেন।
শৈশবে মক্তবে শিক্ষা শুরু করলেও ১৯০৮ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন।পরে তার চাচা কাজী ফজলে করিমের অধীনে কিছু দিন লেখাপড়া শেখেন।পরে স্থানীয় মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম,দর্শন,ইসলামি ধর্মতত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন।। এসময় মক্তবে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। মক্তবে শিক্ষকতার পাশাপাশি মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেন। এতোসব কাজের মাঝেও সাহিত্য কর্মে বিপুলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
স্থানীয় লোকসংগীতের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার বসবর্তী হয়ে তিনি লেটো দলে যোগদান করেন। লেটো দলে থেকেই তিনি কয়েকটি কবিতা,ছড়া, গান ও পালাগান রচনা করে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেন।
এরপর গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তির সহযোগিতায় রাণীগঞ্জ শেয়ারশোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের ধরা বাধা নিয়ম তিনি একদম ই সহ্য করতে পারতেন না, তাই তিনি হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে উধাও হন।
আর্থিক অভাব অনটনের কারণে তিনি আসানসোলের এক রুটির দোকানে মাত্র পাঁচ টাকা মাসিক বেতনে চাকরি নেন। রুটি তৈরীর ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিভিন্ন কবিতা,গান,গজল ইত্যাদি রচনা করেন এবং বিভিন্ন বই পত্র পড়ে তার জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন। তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এক পুলিশ ইন্সপেক্টর তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এবং ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। পরে সেখান থেকে শিয়ারশোল স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কবি সৈন্য দলে যোগদান করে করাচী যান। যুদ্ধ শেষ হলে বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দিলে ১৯১৯ সালে কবি ফিরে আসেন নিজ মাতৃভূমি চুরুলিয়া গ্রামে। এরপর শুরু হয় তার একনিষ্ঠ কাব্য চর্চা। তার লেখা একাধারে দৈনিক বসুমতী, মুসলিম ভারত,মাসিক প্রবাসী,বিজলী,ধুমকেতু প্রভৃতি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। তিনি এসময় বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনার কাজেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন এবং চিত্র জগত ও রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ত হন। অর্থাৎ নানা পেশায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কবিতা তদানীন্তন রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে ছিলো। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের নিপীড়িত, নির্যাতিত,,শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জাগরণে তিনি ছিলেন মহান প্রবক্তা।
১৯২১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত অমর কবিতা ” বিদ্রোহী “। যা বাংলা সাহিত্যে তাকে ” বিদ্রোহী কবি ” হিসেবে অমর করে রেখেছে। কবিতার কয়েকটি লাইন এরকমঃ
বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি,
নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-
বল মহা বিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি,
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি,
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-
বিধাত্রীর!
তার বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, কাব্য গ্রন্থঃ অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি,সাম্যবাদী, সর্বহারা, সিন্ধু হিন্দোল,চক্রবাক,ছায়ানট,পূবের হাওয়া,ফনি মনষা,উপন্যাস ঃ মৃত্যু ক্ষুধা, কুহেলিকা, গল্পগ্রন্থঃ ব্যথার দান, রিক্তের বেদন,শিউলি মালা, প্রবন্ধগ্রন্থঃ যুগবাণী, রুদ্র মঙ্গল, নাটক ঃ ঝিলিমিলি, আলেয়া,মধুমালা ইত্যাদি।
১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামের ৫টি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। আনন্দ ময়ীর আগমনে,বিদ্রোহীর কৈফিয়ত, যুগবাণী, বিষের বাঁশি ও ভাঙ্গার গান। পরের পর্বে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
এই যে,কাজী নজরুল ইসলাম,” বিদ্রোহী কবি” হিসেবে যিনি খ্যত, তিনি কিন্তু শুধু বিদ্রোহ মুলক কবিতা লেখেন নি।তিনি যথেষ্ট প্রেম মূলক কবিতাও রচনা করেছেন। নিজে প্রেমে জড়িয়ে ও পড়েছেন বহুবার। আবার প্রেমে ছ্যাকাও খেয়েছেন। একটা কবিতায় মেয়েদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন,
“এরা দেবী এরা লোভী
ইহাদের অতি লোভী মন,
এক পেয়ে খুশি নয়
যাচে বহুজন।”
আবার অন্য জায়গায় বলেছন,
“যে পূঁজা পূজিনী আমি স্রষ্টা ভগবানে
যারে দিনু সেই পূঁজা সেই আজি প্রতারণা হানে।”
কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম বিয়ে করেন নার্গিস আসার খানমকে।কিন্তু তিনি ঘরজামাই থাকতে নারাজ থাকায় সেখান থেকে পালিয়ে আসেন।পরে তিনি প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করন। তারপূর্বে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছার প্রেমে পড়েন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো। আইন অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে ফজিলাতুন্নেছার সাথে দেখা করায় তাকে রাজ টিকেট করা হয়েছিলো।বলা বাহুল্য, এদের সবার সাথেই কবির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তবে ফজিলাতুন্নেছা কবিকে সারা দেননি কিন্তু কবি তাকে ঠিকই মনে রেখেছিলেন। বিধির কী আশ্চার্য বিধান, যে বিশ্ব বিদ্যালযে প্রবেশ কবির জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল সেই বিশ্ব বিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গনেই তাকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হলো।
নজরুলের চারজন সন্তান ছিলো, তাদের নামঃ কৃষ্ণ মুহাম্মাদ, অরিন্দম খালেদ(বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।
এমন একজন প্রতিভাবান কবি মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে দুরারোগ্য রোগে ( পিক্স ডিজিজ) আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এটি একটি বিরল রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে কণ্ঠের সাথে সাথে স্মৃতিশক্তিও নষ্ট হয়ে যায়। তিনি লিখতে পারতেননা। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু নজরুলকে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তাকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করান।১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় তাকে ডি.লিট উপাধি প্রদান করেন,১৯৭৬ সালে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং একুশে পদক প্রদান করা হয়।তিনি আমাদের জাতীয় কবি। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগষ্ট, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ই ভাদ্র বিংশ শতাব্দীর প্রধান এই কবি মৃত্যু বরণ করেন। তার প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।