শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৪৪ পূর্বাহ্ন

হোসেনপুরে উত্তর কুড়িমারা গ্রামে নেই কোন বিদ্যালয় : মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত স্থানীয়রা

Coder Boss
  • Update Time : শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫
  • ৫৪ Time View

 

মোঃ আল আমিন, হোসেনপুর,কিশোরগঞ্জ

কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার শাহেদল ইউনিয়নের বৃহত্তম গ্রাম উত্তর কুড়িমারায় নেই কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়।স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রায় ৩০ হাজার জনসংখ্যার এই গ্রামটি এখনও মৌলিক অধিকার প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।তাই অনতিবিলম্বে এই গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন করে শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জোরালো দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

(বহু শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত)
(ভোট কেন্দ্র না থাকায় ভোটাররা ভোট দেয়া থেকে বঞ্চিত)
প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় নিরক্ষরই রয়ে যাচ্ছে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। শিক্ষার অভাবে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ওই গ্রামে শিশু শ্রম, নির্যাতন, মাদকাসক্ত ও বাল্যবিয়ের পরিধি। সরকারি শিক্ষা প্রকল্পের সুফল না পাওয়া শিক্ষা বঞ্চিত গ্রামের শতশত শিশু ও তাদের অভিভাবকদের দাবি গ্রামের যেন সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা জানান, উত্তর কুড়িমারা গ্রামে স্কুল না থাকায় তাদের দূরের স্কুলে গিয়ে পড়তে হয়। অনেক দূরের স্কুল হওয়ায় নিয়মিত ক্লাসও করতে তাদের সমস্যা হয়। তাছাড়া রেললাইন ও ব্যস্ততম সড়ক পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। অনেকেই আবার স্কুলে যেতে না পেরে বিভিন্ন শিশু শ্রমে ঝুঁকে পড়ছে। কোমলমতি শিশুদের দাবি, উত্তর কুড়িমারা গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে সকল শিশুদের পড়াশোনার সুযোগের মাধ্যমে শিশু শিক্ষার হার যেন বৃদ্ধি করা হয়।
গ্রামের শিশুরা প্রতিদিন গড়ে ১.৮ থেকে ২.২ কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ কুড়িমারা গ্রামে অবস্থিত দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হেঁটে যেতে বাধ্য হয়।
দক্ষিণ কুড়িমারার “৪০ নং কুড়িমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়” এবং “পশ্চিম কুড়িমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়”এই দুটি বিদ্যালয়ে এত বেশি শিক্ষার্থী ভিড় করে যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার মান ব্যাহত হয়।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যাওয়া, পরিবেশগত ঝুঁকি এবং শিশুদের ক্লান্তির কারণে প্রাথমিক স্তরেই অনেক শিক্ষার্থী নিয়মিত অনুপস্থিত থাকে এবং ধীরে ধীরে ঝরে পড়ে।
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সামিয়া জানায়,
“বর্ষায় কাঁদায় পা পিছলে পড়ে যাই। স্কুলে বসতে ভালো লাগে না। মা বলে না গেলে অসুবিধা নেই, বাঁচলেই তো হলো।”
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রায়হান বলে,“আমার ছোট ভাইকে নিয়েও যেতে হয়। বইয়ের ব্যাগ আর ওকে ধরে চলা খুব কষ্ট। বন্ধুদের অনেকেই এখন আর স্কুলে আসে না।”
এলাকার একটি প্রবীণ নারী ভোটার, রিজিয়া খাতুন (৬৮), বলেন, “আমার বয়স হয়েছে। ভোট দিতে পাশের গ্রামে যেতে পারি না। চোখে কম দেখি, রাস্তাও ভাল না। তিনটা নির্বাচনে আর ভোট দিই নাই।”
এই গ্রামের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বঞ্চনার জায়গা গ্রামে কোনো ভোটকেন্দ্র না থাকা। বাংলাদেশে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটকেন্দ্র সাধারণত সরকারি বিদ্যালয়গুলোতেই স্থাপন করা হয়।
উত্তর কুড়িমারায় কোনো বিদ্যালয় না থাকায়, এ গ্রামের ভোটারদের সবসময় পাশের গ্রামে গিয়ে ভোট দিতে হয় যা রাষ্ট্রীয় নাগরিক অধিকার প্রয়োগে বড় বাধা।
অনেক বয়স্ক, নারী ও প্রতিবন্ধী ভোটার এই কারণে ভোট দিতে অপারগ হন।
এছাড়া নারী শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে যাতায়াত আরও বেশি সংকটপূর্ণ। অভিভাবকরা তাদের পাঠাতে ভয় পান।
এই পরিস্থিতি থেকে পালাতে গিয়ে একাংশ পরিবার কন্যাশিশুদের অল্প বয়সেই স্কুল ফেলে বিয়ের পথে ঠেলে দিচ্ছেন।
এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার হার যেমন নিচে নামছে, তেমনি সমাজে বেকারত্ব, কিশোর অপরাধ, শিশুশ্রম ও সচেতনতা–সংকটও বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, হোসেনপুর উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার প্রায় ৯৩.৪%, কিন্তু এই গ্রামের ক্ষেত্রে বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। হোসেনপুর উপজেলায় ১১০ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ উদ্দিন বলেন,এ গ্রামে বিদ্যালয় না থাকার কারণে শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে। গ্রামে ভোট কেন্দ্র না থাকায় সাধারণত বয়স্ক ভোটারা দূরের কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে বিরম্বনার সম্মুখীন হয়।তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরোধ দ্রুতই গ্রামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করার করুন।
একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক কফিল মাস্টার বলেন,“শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড। এখানে স্কুল না থাকায় এই প্রজন্ম মেরুদণ্ডহীন হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয় মানে শুধু বই পড়া না, সচেতনতা, মূল্যবোধ, অধিকার শেখা সবকিছুর ভিত্তি।”
অবিলম্বে উত্তর কুড়িমারা গ্রামে কমপক্ষে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন এবং স্থায়ী ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনগণ। প্রয়োজনে এই বিদ্যালয়কে পরবর্তীতে কমিউনিটি সেন্টার ও স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

একটি গ্রামে বিদ্যালয় না থাকা কেবলমাত্র একটি শিক্ষা সংকট নয় এটি নাগরিক অধিকার, গণতন্ত্র, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অবহেলার প্রতিচ্ছবি।

সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের উচিৎ এই সংকটকে দ্রুত চিহ্নিত করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এই প্রজন্মকে আর অন্ধকারে রেখে আমাদের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
হোসেনপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগে জমিদাতা পাওয়া গেলে মহা পরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে আবেদন করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102