শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৫৫ পূর্বাহ্ন

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি

Coder Boss
  • Update Time : সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫
  • ৭১ Time View

 

এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী:

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ঝুঁকি। আশ্রয় শিবিরে দীর্ঘমেয়াদী অবস্থানের কারণে হতাশা, ক্ষোভ ও ভবিষ্যৎহীনতা দেখা দিতে পারে, যা সমাজ ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। এছাড়াও, রোহিঙ্গাদের মধ্যে মাদক, মানবপাচার, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায় এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট জালিয়াতির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গারা মাদক ব্যবসায়, মানবপাচার ও অবৈধ অস্ত্রের কারবারের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। প্রভাবশালী ও অসাধু ব্যক্তিদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র ও বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাচ্ছে, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সংগঠনের মাধ্যমে আসা অস্ত্র-গোলাবারুদ দেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি সংগঠন ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের হাতে যাচ্ছে, যা জাতীয় নির্বাচনের সময় চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি করছে।

রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্মের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ ও ভবিষ্যৎহীনতা বাড়ছে, যা সমাজ ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও দৃঢ, সমন্বিত ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে হবে।
রাহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন না করতে পারলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর অতীতের মতো সমস্যা জীবন্ত রাখার বদলে সমাধানের পথও সন্ধান করা হচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ-নীতিনির্ধারকরা কক্সবাজার, উখিয়া, টেকনাফে সরেজমিন দেখে গেছেন রোহিঙ্গা সমস্যার নানা দিক। স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে বর্তমান সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সমস্যা সমাধানের জন্য একটি বলিষ্ঠ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে, আরাকান আর্মি কর্তৃক রাখাইন অঞ্চল দখলে নেওয়ার পরে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা আবারও হুমকির মুখে পড়েছে। পরিস্থিতি এখন শুধু মিয়ানমারের জান্তা সরকারের হাতে নেই। এতে আরাকান আর্মির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী বড় দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকাও প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা ইস্যু একটি কঠিন ও জটিল সমস্যা। দিন যত গড়াচ্ছে ততই যেন এর সমাধানের পথ দূরে সরে যাচ্ছে। যে যাই বলুক, এটা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় জাতীয় সমস্যা। দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গারা ফেরত না গেলে আগামী ৫-৭ বছরের মাথায় এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য কতখানি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
ক্যাম্পগুলো ঘিরে মানব পাচারসহ মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের বিস্তার ঘটছে ভয়াবহভাবে। ক্যাম্পের ভেতরে স্বার্থান্বেষী এনজিও, মাদক, মানব ও অস্ত্রপাচার গোষ্ঠী এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে শুধু বাংলাদেশ নয়, চীন ও ভারত ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে রাখাইন অঞ্চলে যেসব অবকাঠামো তৈরি করেছে, তার নিরাপত্তা সব সময় হুমকির মধ্যে থাকবে। যেকোনো বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বাংলাদেশের জন্য জরুরি, সময়ক্ষেপণ ঠিক হবে না। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সরকার এবং তার সঙ্গে জোরালোভাবে ট্র্যাক টু ও ট্র্যাক থ্রি কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে এবং আমাদের অবস্থান সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে- এই মর্মে যে, রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে বাংলাদেশ কারও পক্ষে বা বিপক্ষে নয়।

বস্তুত বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য একটি শক্তিশালী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে, সে পরিস্থিতিতে সমস্যার নানামুখী বিস্তার ঘটছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়দের দূরত্ব ও দ্বন্দ্বের মতোই ক্যাম্পে আশ্রিতদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে স্বার্থ ও মতাদর্শভিত্তিক দল, উপদল। স্থানীয় রাজনীতির শক্তি বৃদ্ধিতে তাদের ব্যবহার করার কিছু প্রচেষ্টার কথাও জানা যাচ্ছে। বিশেষত, সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলে বসবাসকারী বর্তমান বাংলাদেশি ও সাবেক রোহিঙ্গা, যাদের পূর্বপুরুষ বেশ আগে আরাকান থেকে উচ্ছেদ হয়ে এসেছিল, তারা একটি উগ্র গোষ্ঠীগত-জাতিগত উত্তেজনা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। তারা আগে আসা ও সম্প্রতি আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি প্রেসার গ্রুপ তৈরি করছে। যদি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে না পারে, তাহলে তাদের ক্যাম্প ভেঙে লোকালয়ে বসবাস করার ব্যবস্থা করতে কাজ করছে এরা। এদের পেছনে রয়েছে দেশি ও বিদেশি অর্থদাতা চক্র।

রোহিঙ্গাদের প্রয়োজন নিজেদের অধিকার নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া, বাংলাদেশের প্রয়োজন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ও অন্যান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি টেকসই প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে নানা রকমের নতুন সমস্যা ও ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেসব সমস্যা বাংলাদেশকেই এককভাবে সামাল দিতে হবে।

রোহিঙ্গাদের কারণে বর্তমানে যে মানবিক, আর্থিক, সামাজিক বা পরিবেশগত সমস্যা চলছে, সামনের দিনগুলোতে এর সঙ্গে যদি রাজনৈতিক ও সামরিক সমস্যা যুক্ত হয়, তা বাংলাদেশের জন্য বিরাট বিপদ তৈরি করবে। পাশেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অস্থির ও নানাবিধ সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কারণে নাজুক। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ঘিরে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সমস্যার সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হবে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

অতএব, রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি কেবল মানবিক ত্রাণ সহায়তার পরিসরে দেখার অবকাশ কম। দূরদৃষ্টিতে নিয়ে দেখলে বুঝা যায়, এ সমস্যার দীর্ঘসূত্রতা ও বিস্তারের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি ও বিভিন্ন মাত্রার চ্যালেঞ্জও অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। কাজেই প্রত্যাবাসন কেবল রোহিঙ্গাদের জন্যই নয়, বাংলাদেশের জন্যও স্বস্তিদায়ক বিষয়। রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধান না হলে দ্রুতই এই সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকির কারণ হতে পারে।

লেখক: মহাসচিব, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম জাতীয় কমিটি, চেয়ারম্যান, পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ, উখিয়া, কক্সবাজার।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102