শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:২১ অপরাহ্ন
শিরোনাম:
কবিতাঃ কসুর! নিয়ামতপুরে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে ভ্যান চালকের মৃত্যু শরিয়ত ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা চায় খেলাফত মজলিস- ড. আব্দুল কাদের লুটপাটের অভিযোগ নাকি প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর ছক – ধর্মপাশায় আলোড়ন ধর্মপাশায় জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য প্রকল্প ব্রাক স্বাস্থ্য সেমিনার মোরেলগঞ্জে ইট সোলিং সড়ক মরণফাঁদে পরিণত, ভোগান্তিতে লাখো মানুষ মোরেলগঞ্জে ঝুঁকিপূর্ণ কাঠের পুলে চলাচল শিক্ষার্থীসহ তিন ইউনিয়নের লাখো মানুষ দুর্ভোগে ফেসবুক ইনকামের ধোঁকা: বাস্তবতা বুঝে ফিরে আসুন নিজের জীবনে লালমনিরহাট জেলায় জন্ম আমার বটিয়াঘাটায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক সুপারভাইজারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ: তদন্ত ও শাস্তির দাবি শিক্ষক সমাজের

গল্পঃ ফজিলাতুন্নেছা মহল

Coder Boss
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ১৮ Time View

লেখকঃ মাকসুদা খাতুন দোলন

রাত ফুরিয়ে প্রায় ভোররাত। ফজিলার ঘুম ভেঙে যায়। হাত বাড়িয়ে সুইচ চেপে ঘরে আলো জ্বালালেন। মেয়ের হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলেন। ওযু করে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে জায়নামাজে বসেই যিকির,দোয়া দুরুদ পড়েন। ফজরের আযান শুনে ছেলে-মেয়েকে ডাকলেন। দু’সন্তানকে সাথে নিয়ে সালাত আদায় করে কিছু সময় কোরআন তেলাওয়াত করলেন। ভোরের আঁধার কেটে আকাশ ফর্সা হতেই ঘর,বাড়ির আঙিনা ঝাড়ু দিলেন। বারান্দার উনুনের ছাঁই তুলে আগুন ধরালেন। মেঘ বৃষ্টির দিনগুলোতে রান্নার কাজটা বারান্দায় করেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর পুরনো রান্নাঘর ঠিক করা হয়নি। এক চালা টিনের ঘরের চালে কয়েক জায়গায় ছিদ্র। একটু ঝড়,বৃষ্টি হলেই সব ভিজে যায়।

অল্প তেলে কড়াইয়ে চারটে শুকনো মরিচ সাথে একটা ডিম ভেঁজে ঝুরি করে তাতে রাতের ভাত মিশিয়ে ভাত ভাঁজি করলেন। খাবার নিয়ে মেয়েটার কোনো বায়না নেই। কোনো অভিযোগ নেই। মা পেঁয়াজ,কাঁচামরিচ চটকে পানিভাত খেতে দিলেও টু শব্দটি করবে না। অমৃত স্বাদে খেয়ে উঠবে। কিন্ত ছেলেটা মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে জেদ ধরে। বড় বোন বুঝিয়ে বললে চুপচাপ খেয়ে উঠে। ফজিলা ভাতের থালা নিয়ে ঘরে আসলেন। ছেলে মেয়ে দুটো এক টেবিলেই পড়ছিল। তিনি কাছে গিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন দু’জনকে। মেয়ে ইরিনা খুব ভালো করেই জানে মা সকালে তেমন কিছু রান্না করেন না। রাতের ভাত দিয়েই সকাল বেলার নাস্তাটা কোন রকম চালিয়ে নেন। মা কিছুই খেলেন না মেয়েটা লক্ষ্য করে বলল,

‘নিজের প্রতি তুমি খুব অবিচার করো মা! আমাদের পেট ভরে খাইয়ে তুমি শান্তি পাও আর তুমি যে সব সময় কম খাও আমাদের কষ্ট হয় না?’
ছেলে জুয়েল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ফজিলা কিছু না বলে পানির গ্লাস এনে মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন,

‘পানি খেয়ে দু’জনে ভালো করে পড়া রিভাইস দে!
পরীক্ষা ভালো করে দিস।’
ভাত কম থাকায় আজ নিজে খেতে পারেন নি। চিড়ার কৌটা থেকে অল্প চিড়া ভিজিয়ে কলা দিয়ে চটকে খেয়ে নিলেন। কলপাড় থেকে ওযু করে আইতুল কুরসি পড়ে ছেলেমেয়ে দুটোর গায়ে ফুঁ দিলেন। গা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘ব্যাপারি বাড়ির শিমি,রিমিকে পড়াতে যাচ্ছি। আগের দিন বলে দিছিল বিকালের পড়াটা আজ সকালে পড়বে। দরজায় তালা দিয়ে সাবধানে যাস। আমি চাবি নিয়ে গেলাম।’

এইচএসসি পাশ ফজিলা স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে টিউশনি এবং সামান্য সরকারি ভাতা দিয়ে সংসার চালান। প্রাইমারি শাখার বাচ্চাদের বাংলা,আরবি পড়ান। স্বামী সামান্য বেতনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সরকারি চাকুরি করতেন। অবসরের পর পেনশনের টাকা স্বামীর চিকিৎসায় খরচ করেন। শেষ পর্যন্ত স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে পারেননি। ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে না ফেরার দেশে চলে যান।

ফজিলা দরদর করে ঘামছেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। তালা খুলেই ফ্যান ছাড়লেন। মাথার উপর ঘটাং ঘটাং শব্দে সিলিং ফ্যান ঘুরলেও গরম কমছে না। বোরখা খুলে জগ থেকে ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেলেন।

বিকালে টিউশনিতে যেতে হবে। ক্লান্ত,ঘামভেজা শরীর নিয়ে উনুন ধরালেন। তড়িঘড়ি করে দুপুরের জন্য ভাত,ছোট চিংড়ি দিয়ে কচুর লতি,কুমড়ো পাতা ভাঁজলেন। ছেলে কচুর লতি খেতে চায় না। ছেলের জন্য একটা ডিম ভুনা করলেন। বেলা গড়িয়ে দুপুর। ইরিনা কলেজ থেকে ফিরেছে। আজ এইসএসসি টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো। ফজিলা গোসল,নামাজ শেষ করে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে খেতে বসলেন। ছেলে মেয়ে দুটোর পাতে তরকারি তুলে দিয়ে বললেন,

‘শুক্রবার রিমিদের বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে। রিমির বাবা নতুন বাড়ি করেছে তাই লোকজন দাওয়াত করে খাওয়াবে।’
জুয়েল কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘তোমাকে দাওয়াত দেয় নি মা?’
‘না এখনও কিছু বলেনি। সময় আছে তো!’
জুয়েল বেশ উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

‘দেইখো তোমার সাথে ‘বু’ আর আমাকেও যেতে বলবে। আমি কিন্ত যাবো মা!’

ফজিলা নিরুত্তর,নির্বাক। চুপচাপ খাচ্ছেন। চোখ দুটো ঝাপসা। মনের অজান্তেই স্বামীর কথাগুলো মাথায় ঘুরছে। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘তোর আব্বার খুব ইচ্ছে ছিল অবসরের পর পেনশনের টাকা দিয়ে সুন্দর বাড়ি বানাবে। বাড়ির নাম হবে ‘ফজিলাতুন্নেছা মহল’। তোর আব্বা আমাকে কোনোদিন ফজিলাতুন্নেছা ডাকতেন না। বড় নাম পছন্দ ছিল না। তিনি নাম দিয়েছিলেন ফজিলা খাতুন। ফজিলা নামেই ডাকতেন। প্রায়ই বলতেন,ফজিলা একটু ধৈর্য ধরো। আল্লাহ আমাদের ইচ্ছা পূরণ করবে। ইচ্ছে আর পূরণ হলো কই? মানুষটাই তো আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমার বাড়ির দরকার ছিল না আল্লাহ তোদের আব্বারে বাঁচায়ে রাখতো।
কথাগুলো বলেই ফজিলা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। ছেলে-মেয়ে দুটো ফ্যাল ফ্যাল করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের চোখের পানি তারা সহ্য করতে পারে না। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা-ই তাদের আগলে রেখেছে। বাবা বেঁচে থাকলে তারা আরও অনেক ভালো থাকতো। ছেলে-মেয়ে দুটো বাবার জন্য কষ্ট পায়। বাবাকে মনে করে নিঃশব্দে কাঁদে।

সুলমান ব্যাপারি বাড়ি থেকে দাওয়াত পায়নি দরিদ্র গৃহশিক্ষক ফজিলা। সন্তান দুটো কষ্ট পাবে তাই গোপন করলেন। ছেলে জিজ্ঞেস করলে বললেন,’শরীর ভালো নেই বাবা। আজ কোনো টিউশনে যাবো না।’ শুক্রবার দিন ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে স্বামীর কবরের কাছে গেলেন। মোনাজাত করলেন। দুপুরে নিজেদের খাবারে যা আয়োজন ছিল তা থেকে একজন ভিক্ষুককে পেট ভরে ভাত খেতে দিলেন।

অভাব অনটনের সংসারে ফজিলা সন্তান দুটোর লেখাপড়ার খরচ চালাতে হাল ছাড়েননি।
তার একটাই ইচ্ছে সন্তান দুটো যেন আর্দশ,নেক সন্তান হিসেবে গড়ে উঠে। নিজেদের যোগ্যতায় মাথা উঁচু করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। মেয়ে ইরিনা এইচএসসিতে খুব ভালো ফলাফল করে। চান্স পেল ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। ইরিনার দুই বছরের ছোট জুয়েল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে চান্স পেল। জুয়েলের ইচ্ছে লেখাপড়া শেষ করে ব্যবসা শুরু করবে। টানাপোড়েনের সংসারে বেড়ে উঠেছে। অভাব তাদের পিছু ছাড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা,টিউশনি শুরু করে নিজের খরচ চালিয়ে মায়ের জন্য টাকা পাঠায়।
নিজের খরচ থেকেও কিছু টাকা সঞ্চয় করে।

চোখের পলকে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। ইরিনা
বিসিএস দিয়ে সরকারি মেডিকেল কলেজ হসপিটালে জয়েন করে। জুয়েল মাস্টার্স শেষ করে ব্যবসা শুরু করে। মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল,
‘মা তোমার দোয়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে চাই। জীবনে ভালো ভাবে বাঁচতে হলে টাকার বিকল্প কিছু নেই। এই সমাজে টাকা ছাড়া কেউ মূল্যায়ন করে না মা! নামাজে তুমি শুধু দোয়া করবা।’
ফজিলা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘আল্লাহ তরে সুস্থ রাখুক বাবা! যাই করিস হালাল উপার্জন করিস। আর্দশ,নীতিনৈতিকতা চরিত্রে ধারণ করিস।’

ফজিলা বাবার বাড়ির ওয়ারিশের অংশ বিক্রি করে ছেলেকে দিলেন। ছোট্ট পরিসরে ‘মায়ের দোয়া’ নামে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দিয়ে ব্যবসা শুরু করে জুয়েল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাড়ির কাছেই গরুর খামার দিল। দিনে দিনে গরুর দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে,সেই সাথে লাভের পরিমাণও বাড়তে থাকে। জুয়েলের স্বপ্ন আকাশচুম্বী হতে শুরু করলো। দুধ বিক্রি না করে ‘মায়ের দোয়া’ নামে মিষ্টির দোকান এবং বেকারিতে বিনিয়োগ করে। দুই বছরের মধ্যেই ‘মায়ের দোয়া’ দোকানের মিষ্টি সকলের নজর কাড়ে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মফস্বল,শহরে আরও তিনটি শাখা চালু করে। অর্থ,লোকবল এবং কঠোর পরিশ্রমে সময়ের সাথে সাথে জুয়েলের ভাগ্যের চাকা রাতারাতি পরিবর্তন হতে লাগলো।

হঠাৎ স্ট্রোক করে মনসুর ব্যাপারি মারা যান। দুই ছেলে আবেদ,শাহেদ বেশিদূর লেখাপড়া করেনি। কলেজে পা দিয়েই বন্ধুর হাত ধরেই বিড়িতে টান,ধীরে ধীরে মাদক ও জুয়ায় জড়িয়ে পড়ে। টাকা নিয়ে প্রায়ই মা,দুই ছেলের মধ্য ঝগড়া,বাকবিতণ্ড চলে। ছেলেরা জমি বিক্রি করে টাকা দেওয়ার জন্য মা’কে অনবরত চাপ দিতে থাকে। ছেলেদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে মনসুর ব্যাপারির স্ত্রী জুয়েলের কাছে দশকাঠা ধানি জমি বিক্রি করে। জুয়েল দশকাঠা জমি রেজিস্ট্রি করলো মায়ের নামে। ছেলের সাফল্যে মা আবেগাপ্লুত। শুকরিয়া নামাজ পড়েন। মোনাজাতে স্বামী, সন্তানের জন্য দোয়া করেন।

জীবনযুদ্ধে কষ্টের দিনগুলো ফুরিয়ে সুখের দিন এল ফজিলার শেষ জীবনে। বেশিরভাগ সময় ইবাদত বন্দেগীতে সময় কাটান। ছেলে-মেয়ের হাত ধরে পা রাখেন ‘ফজিলাতুন্নেছা মহলে’। দু’সন্তান মায়ের নামে দশকাঠা জমিতেই নির্মাণ করে দু’তলা বাড়ি। নোনাজল ফজিলার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই মেয়ে ইরিনা চোখ মুছে বলল,’যেদিন তুমি ব্যাপারি বাড়িতে দাওয়াত পাওনি সেদিনই দুই ভাই বোন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। তোমার আর আব্বার স্বপ্ন পূরণ করেই নিজেদের কথা ভাববো। আজ আব্বা বেঁচে নেই। কিন্ত আব্বার ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছি। আল্লাহর ইচ্ছায় আর তোমায় দোয়ায় সেটা সম্ভব হয়েছে মা!’স্বামীকে মনে করে ফজিলা ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। ফজিলাতুন্নেছা মহলে আজ আত্মীয়-স্বজন,গ্রামের অনেক লোকের পদচারণা। সবাই এসেছে দাওয়াত খেতে এবং নান্দনিক বাড়িটি একনজর দেখতে। ফজিলা নিজের ঘরে সুলমান ব্যাপারির স্ত্রী শর্মিলাকে যত্ন করে খাবার বেড়ে খাওয়াচ্ছেন। নিঃস্ব শর্মিলা সিক্ত চোখে খাবার খাচ্ছেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Design & Develop BY Coder Boss
themesba-lates1749691102