মোঃ রফিকুল ইসলাম টিটু, ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ)প্রতিনিধি
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের চকিয়াচাপুর গ্রামে লুটপাট মামলা ঘিরে দেখা দিয়েছে রহস্য ও নাটকীয়তা। মামলার এজাহার, উদ্ধার হওয়া গরু-ধান এবং প্রত্যক্ষ প্রমাণের অসঙ্গতি পুরো ঘটনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। স্থানীয়রা বলছেন—“এখানে লুটপাট হয়নি, বরং প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য সাজানো হয়েছে মামলা।”
মামলার সূচনা
গত ২৭ আগস্ট চকিয়াচাপুর গ্রামের বাসিন্দা হাবিকুল ইসলাম স্থানীয় থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, ১৭ জন প্রতিপক্ষ তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে ১২টি গরু ও প্রায় ৬০ মণ ধান নিয়ে যায়।
কিন্তু এখানেই শুরু হয় অসঙ্গতি। মামলার টাইপকৃত কপিতে দেখা যায়, গরুর সংখ্যা ১২ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৯-এ।
গরু উদ্ধারের রহস্য
মামলার তদন্তে নামে পুলিশ। অভিযোগ অনুযায়ী লুট হওয়া গরু উদ্ধারে অভিযান চালিয়ে পুলিশ মোট ৭টি গরু উদ্ধার করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—এই গরুগুলোর বেশিরভাগই উদ্ধার হয় বাদীর আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি থেকে।
বাদীর আত্মীয় সিদ্দিকের মেয়ে অভিযোগ করেন—
“একটি ছেলে এসে বলল আমরা বিপদে আছি, গরুগুলো এখানে রেখে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে এগুলো নিয়ে যায়।”
পরিত্যক্ত সৌর প্রকল্পের একটি ঘর থেকেও ২টি গরু উদ্ধার হয়। তবে কে বা কারা সেখানে গরু রেখেছিল, সে বিষয়ে কেউ কিছু জানাতে পারেনি।
অন্যদিকে, পাশের বরই গ্রামের চর থেকে আরও ২টি গরু উদ্ধার হয়। স্থানীয় বজলুর রহমানের বাড়ি থেকেও গরু পাওয়া যায়। গ্রামবাসীর দাবি, তিনি কয়েকদিন আগে গরু বিক্রি করেছেন, কিন্তু বিক্রির কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। আশ্চর্যের বিষয়, উদ্ধার হওয়া গরুগুলোর রঙ ও বৈশিষ্ট্য মামলায় উল্লেখিত গরুর সঙ্গেই মিলে যায়।
ধান উদ্ধারের প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনা
গরুর মতো ধান উদ্ধারের ঘটনাতেও অস্বাভাবিকতা রয়েছে। মামলায় অভিযোগ করা হয়, আসামিরা প্রায় ৬০ মণ ধান লুট করেছে। কিন্তু পুলিশ যে ধান উদ্ধার করে, তা পাওয়া যায় বাদীর আত্মীয়ের ঘর থেকেই।
স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মুজাম্মেল হক সরাসরি বলেন—
“এখানে কোনো লুটপাট হয়নি। বাদী নিজের ঘরের ধান এনে পুলিশকে দেখিয়েছে।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
গ্রামবাসীর বড় একটি অংশ মনে করেন, এ ঘটনা আসলেই রহস্যজনক। কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য বাদী এ মামলা সাজিয়েছেন।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন—
“যদি সত্যিই লুটপাট হতো, তবে গরু-ধান কেন বাদীর আত্মীয়দের ঘরেই পাওয়া গেল?”
পুলিশের ভূমিকা
পুলিশ গরু ও ধান উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও এগুলোর মালিকানা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। থানার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন—
“আমরা যা পেয়েছি, তা আদালতে জমা দিয়েছি। এখন আদালতই নির্ধারণ করবেন আসল মালিক কে।”
তবে স্থানীয়রা পুলিশের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। অনেকেই বলছেন, “পুলিশ কি আসল তদন্ত করেছে, নাকি শুধু মামলার কপি দেখে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছে?”
আইনি বিশ্লেষণ
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, লুটপাট মামলায় যদি উদ্ধারকৃত মালামাল বাদীর নিয়ন্ত্রণাধীন স্থান থেকেই পাওয়া যায়, তবে মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যাবে।
রহস্যে ঘেরা মামলা
সব মিলিয়ে চকিয়াচাপুর গ্রামের এ মামলা এখন পুরো এলাকায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
এজাহারের অসঙ্গতি
গরু উদ্ধারের অস্বাভাবিকতা
বাদীর আত্মীয়দের ঘর থেকে ধান পাওয়া
প্রমাণের দুর্বলতা
এসব কারণে জনমনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—ধর্মপাশায় কি সত্যিই লুটপাট হয়েছিল, নাকি এটি ছিল প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর সাজানো নাটক?