লেখক: এস. এম. সাইফুল ইসলাম কবির
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল, যেখানে নদীর জল আর সাগরের লহর মিশে একাকার, সেখানে মানুষের জীবন অচেনা আবহে বোনা। সকাল হয় তখন, যখন নোনা হাওয়া সুন্দরবনের গেওয়া গাছের পাতায় ঝিলিক ফেলে, আর নদীর জল সূর্যের রশ্মি খেলে নাচতে থাকে। এই অঞ্চলের মানুষ জানে, প্রতিটি দিন একটি যুদ্ধ। জোয়ার–ভাটা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ত পানি—সবকিছুই তাদের জীবনের অংশ।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়েও এই উপকূলের মানুষের একমাত্র ভরসা—‘উপকূলীয় বাঁধ’—আজও দুর্বল। মাটি ফেলে বানানো, পুরোনো, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রবণ বাঁধ প্রতিটি ঝড়ের সঙ্গে ভেঙে পড়ে। বাঁধ ভাঙলে শুধু ঘরবাড়ি নয়, ভেঙে পড়ে স্বপ্ন, ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি।
এই ফিচার রিপোর্টের লক্ষ্য—শোনানো সেই মানুষের কণ্ঠ, যারা বাঁচার অধিকার নিয়ে প্রতিদিন লড়াই করে। শোনানো সেই নদীর গল্প, যা কখনো শান্ত, কখনো বিধ্বংসী। এবং বোঝানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব, যা দীর্ঘ ৫৪ বছরেও পুরোপুরি পূরণ হয়নি।
১. উপকূলের ভৌগোলিক বাস্তবতা: প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই
দক্ষিণাঞ্চল পৃথিবীর ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলগুলোর মধ্যে অন্যতম। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট—সবই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২–৩ মিটার উঁচু। জোয়ারের সময় জল নিঃসঙ্গভাবে ঢুকে পড়ে। নদী-বাহিকার পরিবর্তন, নদী ভরাট হওয়া, স্রোতের দিক পরিবর্তন—সবই বাঁধের উপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে।
এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক ধন—সুন্দরবন। এটি কেবল বাঘ, গেওয়া, পিশাম বা কেওড়ার বন নয়; এটি উপকূলের মানুষের জীবনের ঢাল। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বাঁধ না থাকলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত আরও ভয়াবহ হতো। কিন্তু বাঁধ ভেঙে গেলে লবণাক্ততা বেড়ে যায়, মিঠা পানি দূষিত হয়, বনেও ক্ষতি ঘটে।
২. স্বাধীনতার পরে বাঁধ: ৫৪ বছরের অব্যবস্থাপনা
স্বাধীনতার পর থেকে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে—কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী টেকসই বাঁধ এখনও নেই।
ক) কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট প্রজেক্ট (CEP)
১৯৬০–৭০ দশকে নির্মিত বাঁধ এখনো ব্যবহার হয়। তবে আধুনিক ঝড় মোকাবিলার জন্য এরা যথেষ্ট নয়।
খ) পাউবো (BWDB) ও সরকারি প্রকল্প
নকশা ও মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন থাকায়, বাঁধ প্রায়ই ভেঙে যায়। স্থানীয়দের মতামত নেওয়া হয় না।
গ) আন্তর্জাতিক সহযোগী প্রকল্প
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, জাইকা—সবাই সহযোগিতা করেছে। কিন্তু প্রকল্প শেষ হতেই রক্ষণাবেক্ষণ থেমে যায়।
ঘ) ডেল্টা প্ল্যান ২১০০
বিশ্বমানের পরিকল্পনা। তবে বাস্তবায়নের গতি ধীর। প্রশাসনিক জটিলতা, তদারকির অভাব—সবই প্রকল্পকে স্বপ্নের কাগজে সীমাবদ্ধ করে।
ফল: মানুষ প্রতিটি ঝড়ের পরে বারবার ঘর, জমি, ফসল হারাচ্ছে।
৩. জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত
সমুদ্রপৃষ্ঠ বার্ষিক ৪–৫ মিমি হারে বেড়ে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ও স্রোতের চাপ বাড়ছে। লবণাক্ততা স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে।
২০৫০ সালের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দক্ষিণাঞ্চলের অনেক গ্রাম স্থায়ীভাবে পানির নিচে যেতে পারে। ২০৭০ সালের মধ্যে বহু গ্রাম বসবাসের অযোগ্য হবে। ২১ শতকের শেষের দিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ এক মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এভাবে, টেকসই বাঁধ ছাড়া দক্ষিণ উপকূলের মানুষ, বন, অর্থনীতি—সবই বিপন্ন।
৪. সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল: কয়রা–দাকোপ–শ্যামনগর
আইলা (২০০৯) ও আম্পান (২০২০)
আইলার সময় গ্রামের মানুষ এক বছর পানিবন্দি জীবন কাটিয়েছে। রাস্তা, ঘর, স্কুল—সব ভেসে গেছে। ১ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আম্পান আবার প্রমাণ করল—বাঁধ কতটা দুর্বল। ৪০টিরও বেশি স্থানে ভেঙেছে। ফসল, ঘের, পানীয় জল—সবই ক্ষতিগ্রস্ত।
অবৈধ চিংড়ি ঘের
বাঁধের উপর সরাসরি হুমকি। নদীর জলপ্রবাহ ব্যাহত, বাঁধের পা দুর্বল হয়।
ফল: স্থানীয় কৃষক, জেলে, নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
৫. বাঁধ ভাঙলে মানুষের জীবন: এক মানবিক বিপর্যয়
অর্থনীতি
ধান, ডাল, তরমুজ, কলা—সবচাষ নষ্ট। জমিতে লবণ ঢুকে ৩–৭ বছর ফলন হয় না।
পানি
মিষ্টি পানির অভাব। ৩–৫ কিমি দূর থেকে পানি আনতে হয়।
শিক্ষা
স্কুল বন্ধ, বই-খাতা নষ্ট, শিশু শ্রম বাড়ে।
স্বাস্থ্য
উচ্চ রক্তচাপ, ত্বক রোগ, প্রেগন্যান্সির জটিলতা।
সামাজিক জীবন
পরিবার ছিন্নভিন্ন, শহরমুখী অভিবাসন বাড়ে। ২০৫০ সালের মধ্যে ১.৩ কোটি জলবায়ু অভিবাসী হতে পারে।
৬. টেকসই বাঁধের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা
টেকসই বাঁধের জন্য প্রয়োজন—
জিও-টেক্সটাইল বেস
আরসিসি স্লোপ প্রটেকশন
উচ্চতা অন্তত ৬ মিটার
দশ বছরের ঝড়ের ডেটা বিশ্লেষণ
স্লুইস গেটের বৈজ্ঞানিক নকশা
জলাধার সংরক্ষণ
পরিবেশগত বাফার জোন
বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ফান্ড
বাংলাদেশে অধিকাংশ মানদণ্ড নেই। অস্থায়ী বাঁধ, নকশার ত্রুটি ও দুর্নীতি—বাঁধকে টেকসই হতে দেয় না।
৭. ডেল্টা প্ল্যান ২১০০: স্বপ্ন ও বাস্তব
ডেল্টা প্ল্যান ২১০০–এ রয়েছে—
পোল্ডার শক্তিশালীকরণ
নদী খনন
বন্যা নিয়ন্ত্রণ
বনায়ন
জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং
স্থানীয় কমিউনিটি ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা
কিন্তু বাস্তবায়ন ধীর। তদারকি কম। প্রকল্প তহবিল সীমিত। স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ নেই।
৮. সুন্দরবন: বাঁধের উপর নির্ভরশীল মহাবিশ্ব
বাঁধ ভাঙলে—
লবণাক্ততা বেড়ে যায়
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়
বাঘ, কাঁকড়া, গেওয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়
নদীর পানি মিঠা থাকে না
সুন্দরবন রক্ষা মানে—দেশ রক্ষা।
৯. বিশ্বে উপকূল রক্ষা: আমরা কত পিছিয়ে
নেদারল্যান্ডস: ১০–১২ মিটার উচ্চ বাঁধ, দুর্নীতি নেই।
জাপান: ৮–১০ মিটার সী-ওয়াল, বৈজ্ঞানিক নকশা।
ভিয়েতনাম: মেকং ডেল্টায় বহুস্তরীয় পোল্ডার, স্থানীয় কমিটি বাধ্যতামূলক।
বাংলাদেশ: পুরোনো মাটি-বাঁধ, দুর্নীতি, প্রযুক্তিগত দেরি।
১০. উপকূলবাসীর দাবি: “আমাদের বাঁচার অধিকার ফিরিয়ে দিন”
টেকসই বাঁধ
নদী খনন
অবৈধ ঘের বন্ধ
দুর্নীতি দমন
স্থানীয় অংশগ্রহণ
বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ফান্ড
স্থানীয়রা বলেন:
“আমরা বারবার ঘর হারাই। শুধু শক্ত বাঁধ চাই, তাতেই বাঁচব।”
১১. আগামী ৫০ বছর: সময় এখনই
দক্ষিণাঞ্চল ভেঙে গেলে—
বার্ষিক ৩–৫% জিডিপি ক্ষতি
কৃষি উৎপাদন ৩০–৪০% কমে যাবে
১ কোটি ৩০ লাখ জলবায়ু অভিবাসী
সুন্দরবন হারাবে
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্পায়ন, নগরায়ন—সবই বিপন্ন হবে।
১২. সমাধান: টেকসই বাঁধ ও স্থানীয় অংশগ্রহণ
জিও–টেক্সটাইল ও কংক্রিট স্লোপ
বাঁধ উচ্চতা ৬.৫–৭ মিটার
নদী খনন ও জলাধার সংরক্ষণ
স্থানীয় কমিটি ও গণতান্ত্রিক তদারকি
বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ফান্ড
দুর্নীতি শূন্য সহনশীলতা
১৩. মানুষের কণ্ঠ: বাস্তব অভিজ্ঞতা
“ঘর হারিয়ে আমরা নদীতে ভেসে বেড়াই”—কয়রার জেলে।
“আমার ছেলের বই নোনা পানিতে ভেসে গেছে”—শ্যামনগরের মা।
“বাঁধ ভাঙলে জীবন ভেঙে যায়”—দাকোপের কৃষক।
এই কণ্ঠই প্রমাণ—বাঁধ শুধু প্রকল্প নয়, জীবনরক্ষা।
উপসংহার: স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও প্রশ্ন
‘বাঁধ কি এবার টিকবে?’
উত্তর কেউ দিতে পারে না। এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। এখনই প্রয়োজন—
টেকসই বাঁধ
ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন
দুর্নীতি দমন
স্থানীয় অংশগ্রহণ
সুন্দরবন সংরক্ষণ
উপকূল রক্ষা মানে—বাংলাদেশকে রক্ষা।
বাঁধ শক্তিশালী করা মানে—ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করা।
সময় কম। সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে।
লেখক: এস. এম. সাইফুল ইসলাম কবির
চেয়ারম্যান, জাতীয় মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম
মোবাইল: ০১৭১১-৩৭৭৪৫০
ই-মেইল: smsaifulpress24@gmail.com